মঙ্গলবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বন্ধ হচ্ছে না অবৈধ ভিওআইপি

সাঈদুর রহমান রিমন

বন্ধ হচ্ছে না অবৈধ ভিওআইপি

লাইসেন্স প্রদান, র‌্যাব-পুলিশের নিয়মিত অভিযান, গ্রেফতার, মামলা দায়ের সত্ত্বেও বন্ধ হচ্ছে না অবৈধ ভিওআইপি বাণিজ্য। বিটিআরসি অবৈধ ভিওআইপি (ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল) বন্ধের জন্য নানারকম পদক্ষেপ নিলেও কোনো সুফল মিলছে না। বরং রাজধানী ঢাকা ছাড়াও অবৈধ কল টার্মিনেশন ব্যবসা এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিভাগীয় শহরসহ দেশের বড় বড় শহরেও। গত কয়েক মাসে অবৈধ ভিওআইপি বাণিজ্যের অভিযোগে ৭১ লাখ মোবাইল সিম ও এক লাখ আইপি অ্যাড্রেস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি মোবাইল অপারেটরকে মোটা অঙ্কের টাকা জরিমানাও করা হয়েছে। তবুও থামানো যাচ্ছে না টেলিফোন খাতের সর্বগ্রাসী বাণিজ্যটি। দীর্ঘদিন ধরেই ভিওআইপি বাণিজ্য কেবল ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন তা ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। অন্যান্য বিভাগীয় শহর ছাড়িয়ে ভিওআইপির অবৈধ বাণিজ্য এখন জেলা পর্যায়েও বিস্তৃতি পেতে চলেছে। সম্প্রতি গাজীপুর, বগুড়াসহ বিভিন্ন জেলা থেকেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সরঞ্জাম আটক করা হয়েছে। এই ব্যবসা এখন চলছে অত্যাধুনিক ‘রেডিওলিংক’ প্রযুক্তির মাধ্যমে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারজনিত কারণে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায়ীদের সামনে বিটিআরসি রীতিমতো অসহায় হয়ে পড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে অবৈধ ভিওআইপি কল টার্মিনেশন শনাক্ত করতেও ব্যর্থ হচ্ছে বিটিআরসি। সংশ্লিষ্ট  ব্যবসায়ীরা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সেক্টরের কিছু  লোককে ম্যানেজ করে থাকে। ফলে কললিস্ট মুছে ফেলাসহ আধুনিক সফটওয়্যারের মাধ্যমে অবৈধ ভিওআইপি কল টার্মিনেশনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তারা ভারত থেকে স্বল্পমূল্যে ব্যান্ডউইডথ কিনে ১/২ বা আরও বেশি ই-ওয়ান ভয়েস কানেক্টিভিটি ব্যবহার করে অবৈধ পথে বৈদেশিক কল আদান-প্রদান করছেন। সূত্রমতে, স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় অবাধে চলছে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা। এর ফলে প্রতিদিন রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে কমপক্ষে সাড়ে ১২ কোটি টাকা। বার্ষিক হিসাবে এই ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ হাজার ৫৬২ কোটি টাকারও বেশি। অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা বন্ধ করার জন্যই এ খাতে ৮৮১টি লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে। তবুও অবৈধভাবে ভিওআইপি ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে। গত ৫ বছরে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার অভিযোগে ১৭৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তাতে ৫২৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। বিটিআরসি বাদী হয়ে ৭৬টি ও র‌্যাব-পুলিশ ১৫৫টি মামলা করে। অবৈধ ভিওআইপি বন্ধের ক্ষেত্রে সরকারি তত্পরতা থেমে থাকেনি। একের পর এক অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ভিওআইপি জালিয়াত চক্রের হাতকেই বার বার শক্তিশালী করা হয়েছে, উপরন্তু রাজস্ব হারিয়েছে সরকার। এর আগে বিটিআরসি ভিওআইপি বন্ধের নামে কলরেট কমানোর অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তে ৩১৬ কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে। গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর বিটিআরসি পরীক্ষামূলক আন্তর্জাতিক কল টার্মিনেশন রেট ৩ সেন্ট থেকে কমিয়ে ১ দশমিক ৫ সেন্ট করে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ধারণা ছিল কলরেট কম হলে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায়ীদের কাছে ধরনা দেবেন না কেউ। কিন্তু ফল হয় উল্টো। অবৈধ ভিওআইপি বাণিজ্যের তত্পরতাও কমেনি, সরকারের বৈধ ব্যবস্থার কল সংখ্যাও বাড়েনি। বিটিআরসি সূত্র জানিয়েছে, অবৈধ ভিওআইপি বাণিজ্যে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ৭১ লাখ সিম এবং লক্ষাধিক আইপি অ্যাড্রেস। বিটিআরসির নিয়ম অনুসারে দেশের কোনো মুঠোফোন নম্বরে ২৪ ঘণ্টায় ২০০ মিনিটের বেশি মিনিট কল হলে তা অবৈধ ভিওআইপির ব্যবহার সন্দেহে বন্ধ করা হয়। এ ছাড়াও কয়েকটি মোবাইল অপারেটরকে জরিমানাসহ ৫টি পিএসটিএন অপারেটর ও ৩২টি আইএসপি অপারেটরের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। ভিওআইপি বন্ধে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থার উদ্যোগগুলো বরাবরই কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। র‌্যাবের সহায়তায় বিটিআরসি ছোটখাটো কিছু অবৈধ ভিওআইপি কল টার্মিনেশন ব্যবসায়ীর কর্মচারী ও সরঞ্জাম আটক করলেও বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে রাঘববোয়ালরা। বিটিআরসি সূত্র জানায়, নিয়ম অনুযায়ী একটি মুঠোফোন সংযোগে ২৪ ঘণ্টায় ২০০ মিনিটের বেশি কল হলে তা অবৈধ ভিওআইপির ব্যবহার সন্দেহে বন্ধ করা হয়। আর ইন্টারনেট সংযোগে টানা ৫ ঘণ্টা আপলোডিং ও ডাউনলোডিং সমান মাত্রায় চালু থাকলে সেটিকেও বন্ধ করে দেওয়া হয়। গত কয়েক বছর (২০০৮-১৪) পর্যন্ত বিটিআরসির মনিটরিং বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অবৈধ ভিওআইপির শীর্ষে ছিল রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন দুই টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান বিটিসিএল ও টেলিটক। প্রতিষ্ঠান দুটিকে বার বার সতর্ক করা হলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। এ নিয়ে বিটিআরসি, টেলিযোগাযোগ সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একসঙ্গে অনুসন্ধান শুরু করে। ২০১৩ ও ২০১৪ সালে বিটিসিএল ২৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলাও করে দুদক। কিন্তু রাঘববোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যায়।

ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে সার্ভিস প্রোভাইডার সূত্রগুলোর তথ্যমতে, দেশে দৈনিক ১০ থেকে ১১ কোটি মিনিটের বেশি বৈদেশিক কল রিসিভ হয়। এর প্রায় সাত কোটি মিনিটই আসছে চোরাই পথে। এতে দৈনিক প্রায় ২০ কোটি টাকার বিদেশি কল অবৈধ ভিওআইপির মাধ্যমে চুরি হয়ে যাচ্ছে। এটি প্রতিরোধ করা গেলে সরকার দৈনিক সাড়ে ১২ কোটি টাকা ও বার্ষিক ৪ হাজার ৫৬২ কোটি ৫০ লাখ টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয় করতে পারত। এর বাইরে অপারেটর প্রতিষ্ঠান, গেটওয়ে ও আইসিএক্স প্রতিষ্ঠানগুলো আরও সাড়ে ৭ কোটি টাকা রাজস্ব পেত। অর্থাৎ মাসে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতো বাংলাদেশের। যার পুরোটাই আসত বিদেশি মুদ্রায় বা ডলারে। এই পরিমাণ অর্থের পুরোটাই যাচ্ছে অবৈধ ভিওআইপির কারবারিদের পকেটে। অবশ্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধনের কারণে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার হার ২৫ শতাংশ কমে ১০ শতাংশে নেমে এসেছে। আগে এ হার ছিল ৩৫ শতাংশ’। নিবন্ধনের ফলে মোবাইলে হুমকি, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ কমে এসেছে। এ পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধনের ফলে অপরাধীরা আইনের আওতায় আসছে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সহজেই তাদের চিহ্নিত করতে পারছে। পাশাপাশি জনশৃঙ্খলা, নিরাপত্তা বেড়েছে।

সর্বশেষ খবর