বৃহস্পতিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

শিল্প কারখানা নয় মৃত্যুফাঁদ

দুর্ঘটনায় দায়ী মালিকের বিচার হয় না । এক দশকে ৮১৮৩ জনের মৃত্যু

জিন্নাতুন নূর

শিল্প কারখানা নয় মৃত্যুফাঁদ

গত ১০ সেপ্টেম্বর এভাবেই ধসে পড়েছিল টাম্পাকো কারখানা —ফাইল ছবি

দেশে এমন কিছু শিল্প কারখানা রয়েছে যেগুলো এক একটি মৃত্যুফাঁদ। এসব কারখানা নির্মাণের সময় শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে; যার পরিণতিতে প্রতি বছরই এ ধরনের কোনো না কোনো কারখানায় দুর্ঘটনায় শ্রমিকের করুণ মৃত্যু হচ্ছে। শ্রমিকনেতা, আন্তর্জাতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে শ্রমবান্ধব কারখানা তৈরির জন্য বার বার চাপ দেওয়া হলেও এখনো দেশের অধিকাংশ শিল্প কারখানা সে অর্থে শ্রমবান্ধব হয়ে উঠতে পারেনি। কোনো কারখানায় একটি দুর্ঘটনার পর কিছু দিন মালিকদের শাস্তি ও কারখানার নিরাপত্তাব্যবস্থা বাড়ানোর জন্য আলোচনা করা হলেও পরে সব আগের মতোই চলতে থাকে। রানা প্লাজা ও তাজরীনে দুর্ঘটনার পর পোশাকশিল্পের কারখানাগুলো পরিদর্শনের আওতায় এলেও দেশের শিল্পসংশ্লিষ্ট অন্য কারখানাগুলোর নিরাপত্তাব্যবস্থা উন্নত করতে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)-এর এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরে কর্মস্থলে ৮ হাজার ১৮৩ শ্রমিক প্রাণ দিয়েছেন। আহত হয়েছেন ১৯ হাজার ৬২০ জন। বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সময় শিল্প কারখানায় ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার জন্য কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হলো দুর্ঘটনার সময় জরুরি ব্যবহারের জন্য বিকল্প সিঁড়ি না থাকা, অগ্নিনির্বাপণের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও তা ব্যবহারের দক্ষ লোকবলের অভাব, ফায়ার অ্যালার্ম ব্যবহারের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ না হওয়া এবং কারখানায় পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা না থাকা। এ ছাড়া শ্রমিক ও মালিকদের মধ্যে খারাপ সম্পর্ক, কারখানার মধ্যেই বয়লার ও জেনারেটর স্থাপন, বিভিন্ন রাসায়নিক ও অতিরিক্ত দাহ্য পদার্থ অনিরাপদ জায়গায় রাখাসহ বিভিন্ন কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। বাংলাদেশে শিল্প কারখানাগুলোর মধ্যে পোশাক কারখানা ছাড়াও আছে ওয়াশিং প্লান্ট, জুতা, প্লাস্টিক, রাবার ও ডকইয়ার্ড; যেখানে ঘন রাসায়নিক ও শক্তিশালী বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়। কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, দেশের বড় কারখানা দুর্ঘটনাগুলোর প্রধান কারণ ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ও শ্রম আইনের অনুসরণ না করা। কারখানাগুলোয় বয়লার সঠিক স্থানে না বসিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসানো হয়। গ্যাসের লাইনে অবৈধভাবে বুস্টার মেশিন বসানো হয়। আর যেসব কারখানায় কেমিক্যাল প্লান্ট বসানো হয় সেগুলোয় রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা সঠিক থাকে না। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইনও থাকে ত্রুটিপূর্ণ। এদিকে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী মালিকদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নিতেও দেখা যায় না। বিগত ’৯০-এর দশক থেকে এ পর্যন্ত ২১৮টি কারখানায় দুর্ঘটনার জন্য দায়ী মালিকদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমনকি এজন্য আইনে যে শাস্তি উল্লেখ করা হয়েছে তাও দুর্বল।

কিছু দিন আগে সাভারে কালার ম্যাক্স নামে গ্যাস লাইটার কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে তিনজন প্রাণ হারান। ২০ জন শ্রমিক দগ্ধ হন। এর আগে টঙ্গীর টাম্পাকো কারখানার দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৩৯ জন। চট্টগ্রামের সার কারখানায় অ্যামোনিয়া গ্যাসের ট্যাংকে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় অর্ধশতাধিক শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়েন। আর কারখানাগুলোয় শ্রমিকদের জীবন কতটা ঝুঁকিতে থাকে, সাভারের রানা প্লাজা (১১ শয়ের বেশি জনের মৃত্যু) ও তাজরীনের পোশাক কারখানার (১২২ জনের মৃত্যু) দুর্ঘটনা আরও একবার মনে করিয়ে দেয়। দুর্ঘটনার পর তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চট্টগ্রামের সার কারখানার দুর্ঘটনায় ট্যাংকের নিরাপত্তার জন্য পাঁচ ধরনের সুরক্ষা যন্ত্র নষ্ট হয়ে যাওয়ায় দুর্ঘটনা ঘটে। আর তাজরীনের দুর্ঘটনায় স্থাপত্য নকশায় বড় ধরনের ত্রুটি ছিল। বহির্গমনের সিঁড়িও ছিল না নিয়ম অনুযায়ী। রানা প্লাজায় ভবনের অনুমোদন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে নির্মাণ-পরবর্তী তদারকি প্রতিটি পর্যায়েই নিয়মনীতি মানা হয়নি। টাম্পাকো দুর্ঘটনায় বিস্ফোরণে চার দশকের পুরনো ভবন ধসে পড়ে। শ্রমিকনেতারা বলছেন, দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কারখানা মালিক ও সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতা না থাকার কারণেই বার বার দুর্ঘটনা ঘটে। বিজিএমইএ’র প্রেসিডেন্ট সিদ্দিকুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘যেসব পোশাক কারখানা আমাদের সদস্য নয় তারাই শ্রমবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারছে না। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের কিছু করার নেই।’ গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু বলেন, ‘আইএলও কনভেনশনে কারখানায় নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়ে বলা হলেও বাস্তবে কারখানা মালিকরা তা মানছেন না। শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।’

শ্রমিকনেতা রাজ্জেকুজ্জামান রতন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের শিল্প কারখানাগুলোর নিরাপত্তা অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সরকার ও মালিক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কারখানা মালিকদের বরাবরই বাঁচানোর চেষ্টা করে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না থাকায় তাদের কাছে শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি তুচ্ছ হয়ে পড়ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর