বৃহস্পতিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

রংপুরে বদলে যাচ্ছে রাজনীতি

শাহজাদা মিয়া আজাদ, রংপুর

রংপুরে বদলে যাচ্ছে রাজনীতি

একসময় দাপটের সঙ্গে রংপুরের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন যারা, তাদের অনেকেই বার্ধক্যের কারণে রাজনীতি থেকে অবসরে চলে গেছেন। কেউ চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। তাই বলে থেমে নেই রাজনীতি। তাদের তরুণ সন্তানরা এখন রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন। আবার কেউ নিজের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও যোগ্যতাবলে রংপুরের রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বর্তমানে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তরুণরাই। সরকারি  দলের তরুণ নেতৃত্বরা দারিদ্র্য ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে চান। আর বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে থাকা তরুণ নেতারা তাদের ভাষায় ‘ব্র্যাকেটে বন্দী’ গণতন্ত্রকে মুক্ত করার মাধ্যমে দারিদ্র্য ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।

আসিফ শাহরিয়ারের বড় চাচা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। দলটির কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের তার চাচা। বাবা মোজাম্মেল হক ছিলেন এমপি। মা লায়লা মোজাম্মেলও দীর্ঘদিন রংপুর জেলা জাতীয় মহিলা পার্টির সভাপতি ছিলেন। পারিবারিক সূত্র ধরেই রাজনীতিতে যুক্ত হন আসিফ। তরুণ বয়সেই নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুর-১ (গঙ্গাচড়া) আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। বর্তমানে জেলা জাতীয় পার্টির সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, ‘আমি যখন এমপি ছিলাম তখন দেখেছি তরুণ এমপিরা দেশের জন্য ভীষণ আন্তরিক। দেশটা এগিয়ে যাচ্ছে। তবে আরও এগিয়ে যেত, যদি রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকত। আর এর জন্য দায়ী সুশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না করা। গণতন্ত্রকে ব্র্যাকেটে বন্দী রাখলে তরুণ নেতৃত্ব বিকশিত হবে না।

রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সভাপতি ছিলেন আনিছুল হক চৌধুরী। পাঁচবার এমপি নির্বাচিত হন রংপুর-২ (বদরগঞ্জ-তারাগঞ্জ) আসন থেকে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আনিছুল হক চৌধুরী যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। তার স্ত্রী নিহার চৌধুরীও ছাত্রলীগ থেকে দীর্ঘদিন বদরগঞ্জ উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। আনিছুল হক চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার ছেলে টুটুল চৌধুরী বাবার অসম্পূর্ণ কাজ সম্পন্ন করার প্রত্যয় নিয়ে রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। বাবা-মায়ের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ছাত্রলীগ দিয়ে রাজনীতি শুরু। যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ হয়ে বর্তমানে বদরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং জেলা কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নির্বাচিত হয়েছেন ইউপি চেয়ারম্যান। আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পথ পরিষ্কারে নেমেছেন। দারিদ্র্য, দুর্নীতি এবং মাদকমুক্ত দেশ ও সমাজ গড়তে চান তিনি। এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে নিজ এলাকায় কাজও শুরু করেছেন। এজন্য তরুণদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। রংপুর জেলা বিএনপির টানা ১৫ বছর সভাপতির দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দলের কেন্দ্রীয় সদস্য ছিলেন শিল্পপতি রহিম উদ্দিন ভরসা। দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের শাসনামলে রংপুর-৪ (কাউনিয়া-পীরগাছা) আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন তিনি। বর্তমানে বয়সের ভারে রাজনীতি থেকে অবসরে। তার ছেলে এমদাদুল হক ভরসা ছাত্রদল থেকে যুবদল হয়ে এখন জেলা বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। নির্বাচনে দল অংশ নিলে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাবার আসনে লড়ার প্রত্যাশা আছে তার। সুশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি দুর্নীতি ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চান তিনিও। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রংপুর সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রদলের প্রচার সম্পাদক ছিলেন রইচ আহমেদ। ছিলেন জেলা কমিটিরও সদস্য। আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় ১৬টি মামলার আসামি হন তিনি। কারাভোগ করেছেন একাধিকবার। এর পরও রাজনীতির হাল ছাড়েননি রইচ। দলও তাকে মূল্যায়ন করেছে। ছিলেন শহর যুবদলের আহ্বায়ক ও জেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক। ২০০৪ সাল থেকে জেলা যুবদলের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সহ-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া জেলা বিএনপির যুগ্ম-আহ্বয়ক ছিলেন। বর্তমানে মহানগর বিএনপির যুগ্ম-সম্পাদক পদে রয়েছেন। তিনি জানালেন, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নেওয়ায় পুলিশের করা ২১টি মামলার আসামি হয়ে ফেরারি দিন কাটাচ্ছেন এই তরুণ নেতা। এত কিছুর পরও তিনি চান দারিদ্র্য ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে। চান গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সক্রিয় অংশীদার হতে। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি থাকা অবস্থায় একাধিকবার ছাত্রশিবিরের নির্যাতনের শিকার হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। এর পরও রাজনীতির হাল ছাড়েননি মোতাহার হোসেন মণ্ডল মওলা। বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদে থেকে রাজনীতিতে সুনাম কুড়িয়েছেন। মিঠাপুকুর থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে সামান্য ভোটে পরাজিত হন। রয়েছে তার বিশাল প্রবীণ ও তরুণ কর্মীবাহিনী। তাদের নিয়েই বিপদে-আপদে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ান তিনি। আগামী সংসদ নির্বাচনে মিঠাপুকুর আসনে প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছাও আছে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়াই তার স্বপ্ন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য, জেলা যুবলীগের সহসভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হয়ে বর্তমানে রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তুষারকান্তি মণ্ডল। এ ছাড়া জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন তরুণ নেতারা, যারা ছাত্রলীগ, ছাত্রদল ও জাতীয় ছাত্রসমাজের জেলা কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন শেষেই সরাসরি মূল দলের নেতৃত্বে চলে এসেছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন— জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক শাহীনুর রহমান সোহেল, সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুজ্জামান চৌধুরী তুহিন, শিক্ষা ও মানবকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক জাসেম বিন জুম্মন, জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদক বিপ্লব বিশ্বাস, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি সাফিউর রহমান সফি, সহসভাপতি কায়সার রাশেদ খান শরিফ, নবীউল্লাহ পান্না, যুগ্ম-সম্পাদক আইনুন নাহার পাপড়ি, সাংগঠনিক সম্পাদক খোকন সরকার, জাহাঙ্গীর আলম তোতা, দফতর সম্পাদক নিধুরাম অধিকারী, প্রচার সম্পাদক রেজাউল ইসলাম মিলন, কোষাধ্যক্ষ শামসুর রহমান কোয়েল, জেলা বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মাহফুজ-উন-নবী ডন, ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক জহির আলম নয়ন, মহানগর বিএনপির যুগ্ম-সম্পাদক শহীদুল ইসলাম মিজু ও ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক আসাদুর রহমান জাহিদ। তরুণ নেতৃত্বের বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক এমপি শাহ আবদুর রাজ্জাক বলেন, নেতা তৈরি করতে হলে তরুণদের নেতৃত্বে আনতে হবে। পদ আঁকড়ে রাখলে নেতৃত্ব তৈরি হবে না। তরুণরা নেতৃত্বে এলে দলে গতিশীলতা আসবে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের অর্গল ভেঙে তরুণরা দল পরিচালনা করলে দেশ ও জাতি এগিয়ে যাবে। তরুণদের এগিয়ে নিতে প্রবীণদের সার্বিক সহযোগিতা জরুরি।

জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, আগামী দিনে তরুণরাই দেশের হাল ধরবেন। এটা সব দলের কেন্দ্রীয় কমিটির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। রংপুরে সব দলে তরুণরা নেতৃত্বে আসায় আশার সঞ্চার জেগেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর