শুক্রবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

সরকারের ওপর জনসংহতির আস্থা, শঙ্কায় বাঙালিরা

পার্বত্য শান্তিচুক্তির ১৯ বছর

ফাতেমা জান্নাত মুমু, রাঙামাটি

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির ১৯ বছর পূর্তি আজ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে সম্পাদিত শান্তি চুক্তির মাধ্যমে প্রায় দুই দশকের রক্তক্ষয়ী সংঘাত-সংঘর্ষের অবসান ঘটে। বিশ্বে এটি একটি বিরল ঘটনা। সরকারের পক্ষে তৎকালীন চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও শান্তি বাহিনীর পক্ষে জনসংহতি সমিতির প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। 

পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে তৎকালীন শান্তি বাহিনীর সশস্ত্র আন্দোলনকারীরা। কিন্তু চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়ায় কিছুটা আস্থাহীনতায় পড়ে জেএসএস। তবে পার্বত্য ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন সংশোধিত আইন পাস হওয়ার পর নতুন করে সরকারের ওপর আস্থা ফিরে পায় তারা। অন্যদিকে বাঙালি প্রতিনিধি ছাড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের নিয়ে গঠিত পার্বত্য ভূমি কমিশন নিয়ে শঙ্কা বেড়েছে পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত বাঙালিদের। সরকারের ওপর আস্থায় টান ধরতে শুরু করেছে তাদের। উভয়পক্ষ মনে করে সরকার পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পার্বত্য শান্তি চুক্তি করলেও পাহাড়ে কাঙ্ক্ষিত শান্তি ফিরে আসেনি। চুক্তি মানা-না মানা নিয়ে পাহাড়ে বেড়ে গেছে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত। এতে চুক্তির সব অর্জন ম্লান হতে বসেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি  বাস্তবায়ন এবং এ নিয়ে পাহাড়ে বসবাসরত  ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও বাঙালিদের মধ্যে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, এর অবসান হবে কি না সেই প্রশ্ন নিয়ে পালিত হচ্ছে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের ১৯তম বার্ষিকী। এ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাণীতে পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীসহ দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানান এবং শান্তি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন। উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি চুক্তি অনুযায়ী খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে শান্তি বাহিনীর ৭৩৯ সদস্যের প্রথম দলটি সন্তু লারমার নেতৃত্বে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অস্ত্র সমর্পণ করে। পরে ১৬ ও ২২ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে চার দফায় শান্তি বাহিনীর মোট এক হাজার ৯৪৭ জন অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সরকার ১৯ বছরে প্রত্যাগত শান্তি বাহিনীর সদস্যদের পুনর্বাসন, সেনাক্যাম্প প্রত্যাহারসহ স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন সংশোধন, পার্বত্য ভূমি কমিশন আইন সংশোধন, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করে চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি পূরণ করে। তবে আঞ্চলিক পরিষদসহ তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচনের জন্য আলাদা ভোটার তালিকা করতে না পারায় পার্বত্য চুক্তির ২৪টি গুরুত্বপূর্ণ ধারা এখনো বাস্তবায়িত হতে পারেনি। চুক্তি অনুযায়ী জেলা পরিষদগুলোর নির্বাচন না হওয়ায় ১৯৯৯ সালের ১২ মে থেকে সন্তু লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদে এখনো অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ বহাল রয়েছে।

এদিকে গত বুধবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় সন্তু লারমা অভিযোগ তুলে বলেন, দেশ-বিদেশের জনমতকে বিভ্রান্ত করতে শান্তি চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা ইতিমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে বলে অসত্য বক্তব্য প্রচার করা হয়েছে। বস্তুত মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। তিনি বলেন, সরকার কেবল পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে টালবাহানা নয়, একই সঙ্গে চুক্তি বাস্তবায়নের দোহাই দিয়ে চুক্তিবিরোধী ও পাহাড়িদের স্বার্থবিরোধী কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে শাসকগোষ্ঠীর কালক্ষেপণের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি জটিলতার দিকে চলে যাচ্ছে।

অন্যদিকে সরকারি দল বলছে, সরকারের পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আর কোনো ধারা অবশিষ্ট নেই। চুক্তির মূল ধারাগুলো সরকার অনেক আগেই বাস্তবায়ন করে দিয়েছে। এ ব্যাপারে তিন পার্বত্য জেলা সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য ফিরোজা বেগম চিনু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পার্বত্য ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সংশোধন নিয়ে জনসংহতি সমিতির যে দাবি ছিল, তা পূর্ণ করেছে সরকার। তাদের ইচ্ছেমতো ভূমি কমিশন গঠন করা হয়েছে।

স্থানীয় বাঙালিদের অভিযোগ, পার্বত্যাঞ্চলে যুগ যুগ ধরে বসবাসরত বাঙালিদের অধিকার বঞ্চিত করতে সরকার সন্তু লারমার সঙ্গে পার্বত্য চুক্তি করেছে। এ চুক্তি পার্বত্যাঞ্চলের মানুষের জন্য কোনো সফলতা নিয়ে আসেনি। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের বিশেষ কোটা দিয়ে স্থানীয় বাঙালিদের সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে জেএসএসের মুখপাত্র সজীব চাকমা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকার পার্বত্য ভূমি কমিশন (সংশোধন) আইনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে এ কমিশনের সফলতা আসবে না। বরং সরকারের ওপর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের যে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তা ক্ষুণ্ন হতে পারে। কারণ পার্বত্য চুক্তির আর বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা অবাস্তবায়িত রয়েছে। এসব অবাস্তবায়িত ধারা বাস্তবায়ন করা হলে পার্বত্য চুক্তি পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে।

পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদের নেতা ইঞ্জিনিয়ার শাহাদৎ ফরাজি সাকিব বলেন, সন্তু লারমার দাবি অনুযায়ী সরকার ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের সংশোধিত আইন পাস করে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করে দিয়েছে। কিন্তু সরকার যাদের নিয়ে চুক্তি করেছে তারা চুক্তি মানে না। পাহাড়ে অশান্তির দাবানল ছড়িয়ে দিচ্ছে তাদেরই একটি অংশ। তিনটা ভিন্ন নামে সন্ত্রাসী গ্রুপের অবৈধ অস্ত্র ও চাঁদাবাজির কাছে জিম্মি পাহাড়ের সাধারণ মানুষ।

সর্বশেষ খবর