শুক্রবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

সাইকেল বিপ্লব

শিমুল মাহমুদ

সাইকেল বিপ্লব

বাংলাদেশে সাইকেল উৎপাদন, বিশ্ববাজারে রপ্তানি ও স্থানীয় বাজার বিকাশে রীতিমতো বিপ্লব শুরু হয়েছে। নগরকেন্দ্রিক যানজট আর বিস্তৃত সড়ক নেটওয়ার্কের মফস্বলেও তারুণ্য ঝুঁকেছে সাইকেলের প্রতি। শুধু শখের বশেই নয়, তারুণ্যের গুরুত্বপূর্ণ বাহনে পরিণত হয়ে উঠেছে বাইসাইকেল। বিভিন্ন বয়সী ও শ্রেণি-পেশার মানুষ এখন গন্তব্যে যেতে স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করছে দুই চাকার এ বাহনটি। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজার বিকশিত হয়েছে, পাশাপাশি বিশ্ববাজারেও চাহিদা বাড়ছে বাংলাদেশের সাইকেলের। ইউরোপের বাজারে সাইকেল রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও ইন্দোনেশিয়ার পরই বাংলাদেশের অবস্থান। একসময় ভারত, চীন থেকে আসা সাইকেলের দখলে ছিল বাংলাদেশ। এখন বিশ্ববাজারে সাইকেল রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। তারা বলেছেন, সরকারের সহায়তা পেলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে তৈরি পোশাকের মতো ইউরোপের বাজার দখল করবে বাংলাদেশের সাইকেল। স্থানীয় বাজারে চাহিদার কারণে অভিজাত এলাকায় স্থাপিত হয়েছে সাইকেল বিক্রির চেইন স্টোর। দেশীয় উৎপাদকরা সাইকেল রপ্তানির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে মনোযোগী হয়ে উঠেছেন। বাড়তি চাহিদার কারণে দেশে সাইকেলের টায়ার-টিউবসহ খুচরা যন্ত্রাংশের কারখানাও গড়ে উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সাইকেল এখন সামাজিক আন্দোলনের অংশ হয়ে উঠেছে। সাইকেল ব্যবহারকারীদের একাধিক সংগঠন সাইকেল নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছে। সাইকেলপ্রেমীদের সংগঠন ‘বিডি সাইক্লিস্ট’-এর বর্তমান সদস্য প্রায় ৭০ হাজার।

বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি সাইকেল : যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা লুসিনটেল গত আগস্টে প্রকাশিত পর্যবেক্ষণে জানায়, চলতি ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ২ দশমিক ৪ হারে বাইসাইকেল বাজার বিকশিত হবে। ইউরোপের দেশগুলোয় বাইসাইকেলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের বাইসাইকেলের চাহিদাও বেশি ইউরোপের বাজারে। লুসিনটেলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালে বাইসাইকেলের বৈশ্বিক বাজারের আকার হবে ৬ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। এ বাজার দখলের বড় সুযোগ এখন বাংলাদেশের সামনে। ইউরোপীয় গবেষণা সংস্থা ইউরোস্ট্যাটের তথ্যে দেখা যায়, ২০০৯ সালে ইউরোপের বাজারে বাইসাইকেল রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল নবম, ২০১০ সালে পঞ্চম স্থানে উঠে আসে বাংলাদেশ। গত কয়েক বছরে সেই ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। তবে রপ্তানি সামান্য বাড়লে ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে চতুর্থ স্থানে যাবে বাংলাদেশ। ২০০৮ ও ২০০৯ সালে বাংলাদেশ যথাক্রমে ৩ লাখ ৭১ হাজার ও ৪ লাখ ১৯ হাজার বাইসাইকেল রপ্তানি করে। ২০১০ সালে রপ্তানি ৫ লাখ ছাড়িয়ে যায়। ২০১১ ও ২০১২ দুই বছরেই সাড়ে ৫ লাখের মতো সাইকেল রপ্তানি হয় ইউরোপের দেশগুলোয়। ২০১৩ ও ২০১৪ সালে রপ্তানি ছাড়িয়ে যায় ৬ লাখ। বর্তমানে ইউরোপের বাজারে রপ্তানির শীর্ষে রয়েছে তাইওয়ান।

শুরু থেকে : রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, চট্টগ্রাম ইপিজেডে অবস্থিত তাইওয়ানের কোম্পানি আলিতা বাংলাদেশ ১৯৯৬ সালে স্বল্প পরিসরে বাংলাদেশ থেকে বাইসাইকেল রপ্তানি শুরু করে। মেঘনা গ্রুপের হাত ধরে তারা বাংলাদেশে ব্যবসায় নামে। এরপর ১৯৯৯ সালে মেঘনা গ্রুপ ইউরোপের বাজারে সাইকেল রপ্তানির ধারায় যুক্ত হয়। মূলত বাইসাইকেল রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে বিশ্ব মানচিত্রে চিনিয়েছে মেঘনা গ্রুপ। বর্তমানে দেশের মোট বাইসাইকেল রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশই করছে এ প্রতিষ্ঠানটি। তারা গাজীপুরে একে একে গড়ে তুলেছে ৫টি সাইকেল ইন্ডাস্ট্রি। মেঘনা গ্রুপ ছাড়াও জার্মান বাংলা, আলিতা, নর্থবেঙ্গল, সিরাজ বাইসাইকেল ও আরএফএল সাইকেল বাজারে সক্রিয় রয়েছে। এসব কারখানায় ৭ হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করছেন।

ছড়িয়ে পড়ছে সাইকেল : সাইকেল ছড়িয়ে পড়েছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। দেশের বিস্তৃত অঞ্চলে সড়ক নেটওয়ার্ক তৈরি হওয়ায় সাইকেল হয়ে উঠেছে যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ বাহন। দেশে বাইসাইকেল জেনারেশন গড়ে ওঠার পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে তারুণ্য। তরুণরা নিজেরা সাইকেল নিয়ে রাস্তায় নামছেন, পাশাপাশি নিজেরা বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন। বিডিসাইক্লিস্ট নামের একটি সংগঠন ঢাকায় সাইকেল আরোহীদের নিয়ে সাইকেল র‌্যালিসহ নিয়মিত কার্যক্রম চালাচ্ছে। এদিকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন সাইকেল বিতরণ করছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে। স্কুলে যেতে দূরত্ব যেন বাধা না হয় এজন্য মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি) রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, জয়পুরহাট, লালমনিরহাট, বগুড়া, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মাঝে ১ হাজারের বেশি সাইকেল বিতরণ করেছে।

বাড়ছে দেশি বাজার : বিশ্ববাজারে রপ্তানির পাশাপাশি সাইকেলের দেশি বাজারও বাড়ছে। ঢাকায় বাইসাইকেলের সবচেয়ে বড় বাজার বংশালে। বংশালের ব্যবসায়ীরা জানান, দেশি বাজারে প্রতি বছর প্রায় ৬ লাখ পিস বাইসাইকেলের চাহিদা; যা ক্রমে বাড়ছে। চীন, থাইল্যান্ড ও ভারত থেকে যন্ত্রাংশ এনে সংযোজন করে বিক্রি হয় বংশালের বাজারে। ডিলারদের মাধ্যমে পাঠানো হয় সারা দেশে। দেশে তৈরি সাইকেল স্থানীয় বাজারে খুব কমই বিক্রি হয়। ব্যবসায়ীরা জানান, দেশি বাইসাইকেলের মূল্য বেশি। এজন্য বিদেশি সাইকেল আসে। দেশের চাহিদার ৬০ শতাংশ এখনো পূরণ করে বিদেশি সাইকেল। আমদানি করা সাইকেলের দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় সেগুলোর চাহিদা বেশি। দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও রাস্তাঘাটের কথা বিবেচনা করে রপ্তানির পাশাপাশি স্থানীয় বাজারের জন্যও সাইকেল তৈরি করছে মেঘনা গ্রুপ ও আরএফএল। তারা ইতিমধ্যে সারা দেশে বিপণন নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। মেঘনা গ্রুপ ‘সাইকেল লাইফ’-এর মাধ্যমে দেশি বিপণন নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করেছে। প্রাণ-আরএফএলের দুরন্ত সাইকেল বর্তমানে দেশি বাজারে সাড়া ফেলেছে। দুরন্ত সাইকেলের দাম ৪ হাজার থেকে ১৬ হাজার টাকার মধ্যে। মূল্য সাশ্রয়ী হওয়ায় ক্রেতা বাড়ছে। সারা দেশে দুরন্ত সাইকেলের ৩ হাজার ডিলার আছে। এ ছাড়া দুরন্ত বাইক গ্যালারি হচ্ছে বিভিন্ন স্থানে।

মেঘনা সাইকেলের বিক্রয় কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখা যায়, সাড়ে ১৩ হাজার থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা দামের সাইকেল বিক্রি হচ্ছে। শোরুমে মেঘনার ভেলোস ব্র্যান্ডের ছয় ধরনের সাইকেল বিক্রি হয়। এর দাম ১৩ হাজার ৫০০ থেকে ২৪ হাজার ৫০০ টাকা। মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, কম শ্রমমূল্য ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তি এখন সহজলভ্য হওয়ায় চীন, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম এবং ইউরোপের যে কোনো দেশের তুলনায় কম মূল্যে এখন বাংলাদেশে বাইসাইকেল তৈরি করা যায়। ফলে আমাদের সামনে বিশ্ববাজার দখলের চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি সাইকেল-শিল্পের জন্য অনুকূল নীতিসহায়তা নিশ্চিত করলে এ সুযোগ কাজে লাগানো যাবে। তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীদের গ্যাস, বিদ্যুৎ সংযোগসহ বন্দর ব্যবহারে অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার। বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি হলে সাইকেল-শিল্প গার্মেন্ট-শিল্পের মতোই সাফল্য বয়ে আনবে। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের সহযোগী দুরন্ত সাইকেল ইন্ডাস্ট্রিজের জেনারেল ম্যানেজার চৌধুরী ফজলে আকবর বলেন, ‘বাংলাদেশে সাইকেল বাজার অনেক বড়। আমরা অপেক্ষাকৃত কম দামে মানসম্পন্ন সাইকেল বাজারে দিচ্ছি। এতে প্রচুর সাড়া পাচ্ছি। প্রতি মাসে আমরা দেশের বাজারে ২৫-৩০ হাজার সাইকেল বিক্রি করি। সামনের বছর টার্গেট ৫০ হাজার।’ তিনি বলেন, ‘আমরা এখন বছরে ২০ হাজার সাইকেল বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যে রপ্তানি করছি। পুরো ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বাজারে আমাদের সাইকেল রপ্তানি হবে। কারণ, সারা বিশ্বে আমাদের অন্য পণ্য বিক্রি হয়।’ ফজলে আকবর বলেন, ‘সাইকেল নিয়ে আমরা একটি অনলাইন নাটক করেছি। এর দর্শক প্রায় ২১ লাখ। অনলাইনেও আমাদের মার্কেট বাড়ছে।’

সর্বশেষ খবর