শুক্রবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

নেত্রকোনা আওয়ামী লীগ সভাপতি যুদ্ধাপরাধী!

প্রতিদিন ডেস্ক

নেত্রকোনা আওয়ামী লীগ সভাপতি যুদ্ধাপরাধী!

একাত্তরে যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে নেত্রকোনা জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মতিউর রহমান খানের বিচার চেয়ে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় আবেদন করেছেন মুক্তিযোদ্ধা মো. শামছুজ্জোহা। আবেদনের সঙ্গে তিনি একাত্তরে শান্তি কমিটির একটি সভার ‘প্রতিবেদনের অনুলিপি’ও দেন, যেখানে সভায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মতিউরের নামও রয়েছে। শামছুজ্জোহা ২০০৪ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত নেত্রকোনা জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ছিলেন। গত সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কার্যালয়ে যে অভিযোগ জমা দেন তাতে বলা হয়, একাত্তরে ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করা তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা’ মতিউরের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের একজন সহযোগীসহ অন্তত দুজনকে ধরে নিয়ে নির্যাতন ও হত্যা করেছেন। তদন্ত সংস্থা বলেছে, তারা নিয়ম অনুযায়ী তদন্ত করবে। অন?্যদিকে, মতিউর রহমান খান কোনো ধরনের অপরাধে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। খবর বিডিনিউজ।

ট্রাইবু?্যনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান বুধবার বলেছেন, তারা মতিউর রহমান খান নামে নেত্রকোনার একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়ে তা নথিভুক্ত করেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংস্থার কাছে এ ধরনের প্রায় ৬০০ অভিযোগ রয়েছে। সংস্থার লোকবলও সীমিত। সীমিত লোকবল নিয়েই তারা কাজ করছেন। তাই এখনই পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে বলা যাচ্ছে না।

মতিউর বলেন, তিনি কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত নন। একাত্তরে তিনি মুক্তারপাড়া এলাকায় শ্বশুরের বাসায় পাক হানাদারদের নজরবন্দি ছিলেন। তার জামিনদার ছিলেন নেত্রকোনা কলেজের অধ্যক্ষ। এই বক্তব্যের সমর্থনে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য রয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, প্রয়োজনে সে সব তিনি হাজির করবেন।

শামছুজ্জোহা তার অভিযোগে বলেন, একাত্তরে তার বাড়ি দুই বার আক্রান্ত হয়েছে। প্রথমবার ২০ এপ্রিল রাজাকার সৈয়দ হাফিজ উদ্দিন, সৈয়দ সোনা মিয়া, ভোলা মিয়া, আল বদর শহীদুল্লাহ পিন্টু ও আবদুর রহিম ফরাজীর নেতৃত্বে বাড়ির মালামাল লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়।

দ্বিতীয়বার পিন্টু-ফরাজী-ভোলা এলেও নেতৃত্বে ছিলেন আল বদর নেতা মতিউর রহমান খান। শামছুজ্জোহা বলেন, ‘ওই দিন রাজাকার-আল বদররা আমার বাড়ির সমস্ত জিনিসপত্র ভাঙচুর করে আগুন দিয়ে দেয়।’ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাড়ি ফিরে তিনি এসব ঘটনা জানতে পেরেছেন।

অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট নেত্রকোনা সদরের কুরপাড়ের মুকতুল হোসেনের বাড়িতে আক্রমণ করে তাকে আটক করে আনসার ব্যারাকে বসানো হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে সারা রাত পৈশাচিক নির্যাতন করা হয়। আল বদর মতিউর রহমান খানের নেতৃত্বে পিন্টু-ফরাজী-ভোলা ওই আক্রমণে অংশ নেয়। তারা পরে মুকতুল হোসেনকে মগড়া নদীর তীরে নিয়ে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়। তার লাশ আর পাওয়া যায়নি। বাড়ি থেকে তাকে আটক করে নিয়ে যাওয়ার সময় এলাকার মানুষ ওই ঘটনা প্রত্যক্ষ করে। তিনি বলেন, ‘আমি সোর্সের মাধ্যমে এসব ঘটনা জানতে পাই। পরে এলাকার লোকজনের কাছে ঘটনা জানতে পেরেছি।’ শামছুজ্জোহা বলেন, একাত্তরে নেত্রকোনা কৃষি অফিসের পিয়ন মুকতুল আওয়ামী লীগের কর্মী ছিলেন। রাজাকার ও আল বদরদের তথ্য সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতেন তিনি।

মতিউরের বিরুদ্ধে অপর অভিযোগ, দুর্গাপুর থানার বিরিশিরি নোয়াপাড়ার অধ্যাপক আরজ আলীকে ধরে নিয়ে নির্যাতন ও হত্যা।

লিখিত অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট আনুমানিক বেলা ১১টার দিকে অধ্যাপক আরজ আলীকে নেত্রকোনা কলেজ থেকে ধরে নেত্রকোনা ভোকেশনাল আর্মি ক্যাম্পে নেওয়া হয়। আল বদর মতিউর রহমান খান, অধ্যাপক মুন্সী আবদুল জলিল, পিন্টু ও ফরাজী এতে অংশ নেয়। পরদিন আরজ আলীকে হত্যা করে আসামিরা লাশ সোমেশ্বরী নদীতে ফেলে দেয়। ওই ঘটনা নুরুজ্জামান, খোরশেদ আলী, আবদুল হামিদসহ অনেকেই দেখেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা আদালতে সাক্ষ্য দিতে প্রস্তুত বলে আবেদনে জানিয়েছেন শামছুজ্জোহা।

মুক্তিযোদ্ধা গোলাম এরশাদুর রহমানের লেখা ‘মুক্তিসংগ্রামে নেত্রকোণা’ বইয়ে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল আজিজ তালুকদার, ডা. হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, নুরুল ইসলাম খান, ছাত্রলীগ নেতা মতিউর রহমান খান (নেত্রকোনা কলেজ সংসদের ১৯৬৯ সালের জিএস), দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার সংবাদদাতা আল আজাদ ও নেত্রকোনা কলেজ সংসদের ১৯৭০ সালের জিএস জাহাঙ্গীর কবীর হানাদারদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন।

প্রায় তিন মাস আগে মতিউরকে সভাপতি করে নেত্রকোনা জেলা আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি হয়। এর আগে তিনি ছিলেন সহ-সভাপতি। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। নতুন কমিটির সভাপতি-সম্পাদকের নাম ঘোষণা হলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি এখনো হয়নি।

একাত্তর সালের আগে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে থাকলেও একাত্তরে পাকিস্তান বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে মতিউর আল বদর বাহিনীতে যোগ দেন বলে শামছুজ্জোহার দাবি। তিনি জানান, মতিউরের ঘটনা তারা লোকমুখে শুনে শুনে জানতেন। পর্যাপ্ত প্রমাণাদির অভাবে অভিযোগ করেননি। শান্তি কমিটির এক সভায় অংশ নেওয়া সংক্রান্ত কাগজ সম্প্রতি পেয়ে যাওয়ায় দাখিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। স্বাধীনতার আগে ১৯৬৮-৬৯ সালে মহকুমা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মতিউর। ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে নেত্রকোনা ডিগ্রি কলেজের জিএস হয়েছিলেন। মতিউর একাত্তরের জুলাই মাসের দিকে আত্মসমর্পণ করেন, তিনি শান্তি কমিটির আহ্বায়কের প্রধান সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। তার শ্বশুর পরিবারের সবাই মুসলিম লীগার। তাদের মাধ্যমেই পাকবাহিনীর সঙ্গে তার সম্পর্ক হয়।

সর্বশেষ খবর