শুক্রবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

যে কারণে সরকারিকরণ হচ্ছে না ফুলবাড়িয়া কলেজ

সৈয়দ নোমান, ময়মনসিংহ

কলেজটির বয়স ৪৪ বছর। প্রতিষ্ঠার আট বছর পরই এমপিওভুক্ত হয়েছে। ডিগ্রি কলেজে উন্নীত হয়েছে আরও ৩০ বছর আগে। কলেজটির শিক্ষার্থী সংখ্যা কম করে হলেও ৫ হাজার। ২০১১ সাল থেকে চালু হয়েছে স্নাতক (সম্মান) কোর্স। কিন্তু এত কিছুর পরও সরকারিকরণ হয়নি কলেজটি। নিয়ম অনুযায়ী সব শর্ত পূরণ করলেও ফুলবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েনি।

নেপথ্যের কিছু কারণ সম্পর্কে জানা গেছে, কলেজটির গভর্নিং বডির সদস্য স্থানীয় সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মোসলেম উদ্দিনের ছেলে অ্যাডভোকেট ইমদাদুল হক সেলিম। আর গোল বাধে এতেই। ফুলবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও স্থানীয় এলাকাবাসী জোটবদ্ধভাবে ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন। টানা ৪৩ দিন যাবৎ হরতাল, অবরোধ, বিক্ষোভ মিছিল, অনশন, কালো পতাকা মিছিল, ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করে আসছিলেন আন্দোলনকারীরা। কিন্তু স্থানীয় সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মোসলেম উদ্দিন তাদের এ আন্দোলনে কর্ণপাত করেননি। ফলে আন্দোলনকারীরাও দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন।

আন্দোলনকারী শিক্ষকরা জানান, কলেজটি সরকারিকরণ করতে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও কলেজ গভর্নিং বডির সভাপতি অ্যাডভোকেট মোসলেম উদ্দিনকে কলেজের সব শিক্ষক মিলে ১০ লাখ টাকা প্রদান করেন। স্থানীয় সংসদ সদস্যও কলেজটি সরকারিকরণের জন্য ডিও লেটার (চাহিদাপত্র) দেন। বার বার তিনি শিক্ষকদের আশ্বস্ত করেন কলেজটি সরকারিকরণ হবে বলে। ২০১৫ সালের ২৯ জুলাই ফুলবাড়িয়া কলেজটি সরকারিকরণের লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি পরিদর্শক দল কলেজ পরিদর্শন করে প্রতিবেদনও জমা দেয়। এরপরও রহস্যজনক কারণে কলেজটি সরকারিকরণ না হয়ে অনেক কম শিক্ষার্থীর বেগম ফজিলাতুন নেসা মুজিব মহিলা কলেজ সরকারিকরণ হয়।

আন্দোলনকারী শিক্ষকরা আরও জানান, ফুলবাড়িয়া কলেজ সরকারিকরণ না হলে নিজেও আন্দোলনে থাকবেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন কলেজটির গভর্নিং বডির সদস্য ও সংসদ সদস্য পুত্র অ্যাডভোকেট ইমদাদুল হক সেলিম। কিন্তু তিনি কথা রাখেননি। আন্দোলন অনেক দিন গড়ানোর পর শুধু একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে দায় এড়িয়েছেন। এ নিয়ে ক্ষোভ-কষ্টের অন্ত নেই আন্দোলনকারীদের মাঝে। তাদের অভিযোগ, এমপিপুত্রের কারসাজির কারণে সরকারিকরণ তালিকা থেকে বাদ পড়েছে কলেজটি।

শিক্ষকরা জানান, এমপিপুত্র অ্যাডভোকেট সেলিমের ভায়রা নাসির উদ্দিন এ কলেজের প্রিন্সিপাল। এমপি নিজের ক্ষমতাবলে কন্যা ফারজানা শারমিন বিউটি ও পুত্রবধূ বিলকিস খানম পাপড়িকে নিয়োগ দিয়েছেন এ কলেজে। কলেজটির প্রিন্সিপাল নাসির উদ্দিনের সরকারি চাকরির মেয়াদ ২০১১ সালে শেষ হলেও তিন কিস্তিতে ৬ বছরের জন্য এক্সটেনশন করেছেন চাকরির মেয়াদ।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধানসহ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক শিক্ষক অভিযোগ করে বলেন, প্রিন্সিপালের দুর্নীতির কারণে কলেজের ফান্ডে কোনো টাকা নেই। নিজের ছেলেকে কমিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজে ভর্তি করার জন্য কলেজ ফান্ড থেকে তিন মাস আগে ১৭ লাখ টাকা নিয়েছেন। নিজে দুটি আলম এশিয়া বাসের মালিক। কলেজটি সরকারিকরণ হলে তিনি আর স্বপদে থাকতে পারবেন না, তাই সরকারিকরণ ঠেকাতে সুকৌশলে তিনি কলকাঠি নাড়েন।

স্থানীয়রা জানান, ফুলবাড়িয়া কলেজ সরকারিকরণ না হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়তেই স্থানীয়রা ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন। একাধিকবার উপজেলায় হরতাল, অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়। প্রতিটি কর্মসূচিই ছিল শান্তিপূর্ণ। কিন্তু গত ২৪ নভেম্বর স্থানীয় সংসদ সদস্যের ছেলে অ্যাডভোকেট ইমদাদুল হক সেলিমের মালিকানাধীন আখালিয়া হেলথ সেন্টারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। আন্দোলনকারীরা বলছেন, এমপিপুত্র সেলিম নিজের সন্ত্রাসী দিয়ে এ ভাঙচুর করান। যদিও পুলিশের দাবি আন্দোলনকারীরাই এ ভাঙচুর করে। পরে তিনটি মামলায় অজ্ঞাত ১৮০ জনকে আসামি করা হয়। এমন মামলায় কলেজটির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলনে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারাও একাট্টা হন। গত রবিবার গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে কলেজের আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ মিছিল করতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। এরপর পুলিশ কলেজের ভিতরে ঢুকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বেদম লাঠিপেটা করে। আন্দোলনকারীদের পুলিশের লাঠিপেটা ও উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবুল কালামের মৃত্যুর ঘটনায় তারা পুলিশের উৎসাহী মনোভাবকেই দায়ী করছেন। এমনকি ওই শিক্ষকের জানাজার জন্য কলেজে মরদেহ আনতে চাইলেও স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন বাধা দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। পরে মঙ্গলবার রাতে ৩৬ ঘণ্টা পর ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হয়।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ময়মনসিংহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নূরে আলম জানান, অহেতুক পুলিশকে দায়ী করা হচ্ছে। বুকে ব্যথা নিয়ে ওই শিক্ষক সেদিন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ওই চিকিৎসকের বক্তব্যের ভিডিও ফুটেজও আমাদের কাছে রয়েছে। সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পুলিশকে এর জন্য দায়ী করা হচ্ছে।

এসব বিষয়ে গতকাল স্থানীয় সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মোসলেম উদ্দিনের মুঠোফোনে ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে এমপিপুত্র ইমদাদুল হক সেলিম বলেন, ‘এমপি মহোদয় তিনটি কলেজের নাম দিয়েছিলেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর মাতার নামে কলেজটি সরকারিকরণ হয়েছে। এখানে আমাদের কোনো হাত নেই। তবে এত দিন আমাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত শিক্ষকরা যে অভিযোগ তুলেছিলেন গতকালের উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে তা প্রমাণ করতে পারেননি শিক্ষকরা।’

এদিকে শিক্ষকসহ দুজন নিহত হওয়ার ঘটনায় বিচারের দাবিতে গতকাল শোক র‌্যালি ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।  বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কালো ব্যাজ ধারণ করে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতাসহ শোক র‌্যালিতে শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ এলাকাবাসীর স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। র‌্যালিটি সদর উপজেলার প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে কলেজ ক্যাম্পাসে এসে সমাবেশ করেছে। সমাবেশে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এতে রয়েছে আজ শুক্রবার মসজিদে দোয়া, শনিবার শোকসভা ও রবিবারে শোক র‌্যালি।

সর্বশেষ খবর