শনিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

সবকিছুতেই ভেজাল

খাবার-ফলমূল প্রসাধনী ওষুধ চিকিৎসাসেবায় ব্যবহূত সুই সিরিঞ্জও বাদ নেই

মাহবুব মমতাজী

সবকিছুতেই ভেজাল

মানুষের খাবার, চিকিৎসা, প্রসাধনী, এমনকি যানবাহনে ব্যবহূত উপকরণেও ভেজালের ছড়াছড়ি। যেন ধীরে ধীরে সব কিছু অনিরাপদ হয়ে উঠছে অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যে। সম্প্রতি মানুষের অন্যতম যোগাযোগ মাধ্যম মুঠোফোনেও লেগেছে ভেজালের ছোঁয়া। আর প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় নকল-ভেজাল শিশু খাদ্যে এবং মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রিও হয় বিভিন্ন মার্কেটে। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ভেজাল হচ্ছে। সে অনৈতিক কাজে ভ্রাম্যমাণ আদালতে ধরা পড়ার পরেও পরবর্তীতে পার পেয়ে যায় তারা। সরকারি বিভিন্ন সংস্থা অভিযান চালিয়ে জেল-জরিমানা করলেও থামছে না এসব জীবনহানিকর কর্মকাণ্ড। বাজারে জীবন সুরক্ষার জন্য রোগ প্রতিরোধে ব্যবহূত অনিরাপদ চিকিৎসা সামগ্রীর ছড়াছড়ি। চিকিৎসা সেবায় ব্যবহূত গ্লাভস, সুই, সিরিঞ্জ, ইনজেকশন, সুতা এবং হার্টের রিংয়েরও নেই কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও মাননিয়ন্ত্রণ।

অভিযোগ করে মাসুদুর রহমান নামে এক নগরবাসী বলেন, আমরা যাব কোথায়। আমাদের যাওয়ার জায়গা নেই। দোকানে গেলে সেখানে খাবারে ভেজাল। কাঁচাবাজারেও ফরমালিনের ভয়। গাড়ির মালামালেও দুই নম্বরী। বাচ্চাদের খাবার কিনব সেখানেও ভেজাল। ডাক্তারের কাছে যাব কিংবা জীবন বাঁচানোর জন্য ওষুধ খাব তাতেও শুনি নকল ওষুধ। ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনাকারী র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভেজাল কর্মকাণ্ডে সব ক্ষেত্র অনিরাপদ হচ্ছে এটা ঠিক। এসব প্রতিরোধে আইন প্রয়োগ করে শতভাগ সফলতা পাওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে দরকার সমন্বিত উদ্যোগ। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোকে একযোগে কাজ করতে হবে। ব্যবসায়ীদের মাঝে নৈতিকতা বাড়ানোর বিষয়ে জোর দিতে হবে। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন এবং ভোক্তা সংগঠনকে আরও বেশি তত্পর থাকতে হবে। কিছুদিন আগেও এক অভিযানে এক ব্যবসায়ীকে ভেজাল শিশুখাদ্য বিক্রির সময় আমরা ধরেছিলাম। সে অনেক প্রভাবশালী ও টাকার মালিক ছিল। এ ধরনের লোকদের দ্বারাই এসব কাজ বেশি হয়। কথা হয় লোকমান নামে কাপ্তান বাজারের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের দ্বারা নকল বা ভেজাল পণ্য সরবরাহের উপায় নেই। আমরা তো কোম্পানির কাছ থেকে এনে পণ্য বিক্রি করে থাকি। ভেজাল-নকল যা কিছু হয় কোম্পানির লোকেরাই করে। ঢাকা জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, গত ৭ সেপ্টেম্বর ভেজাল পণ্য ও খাবার বিক্রি করার অভিযোগে উত্তরার ডেইলি শপিং মল ও নিউ বি-বাড়িয়া বেকারিতে অভিযান চালায় ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় প্রতিষ্ঠান দুটিকে দেড় লাখ টাকা জরিমানা করে আর্মড ব্যাটালিয়ন পুলিশ (এপিবিএন-৫), বিএসটিআই ও জেলা প্রশাসনের যৌথ অভিযানে। অভিযানে বিএসটিআইর অনুমোদনহীন ভেজাল শ্যাম্পু, স্ক্রিন ক্রিম ও মশার কয়েল, ভেজাল ময়দা, ক্ষতিকারক রং মেশানো রুটি, কেক ও বিস্কুট জব্দ করা হয়। র‌্যাব সূত্র জানায়, গত ৫ সেপ্টেম্বর বিক্রয় নিষিদ্ধ ওষুধ ও গরু মোটাতাজাকরণের ওষুধ সরবরাহের অভিযোগে পুরান ঢাকার ১২ জন ব্যবসায়ীকে বিভিন্ন মেয়াদে জেল ও জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। পুরান ঢাকার বাবুবাজার এলাকার আমির মেডিসিন মার্কেটে র‌্যাব-১০ ও ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর যৌথভাবে এই অভিযান চালায়। এ ছাড়াও মেয়াদোত্তীর্ণ রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে প্যাথলজি সেবা ও অনিবন্ধিত ওষুধ সরবরাহের অভিযোগে রাজধানীর কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। ধানমন্ডিতে ওষুধ অধিদফতর ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের সমন্বয়ে র‌্যাব-২-এর অভিযানে মেডিনোভা ডায়াগনস্টিকসকে আট লাখ টাকা এবং ডায়াগনস্টিকের ফার্মেসিতে অনিবন্ধিত ওষুধ রাখার অপরাধে আরও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। গত ১ সেপ্টেম্বর শ্যামলী, মোহাম্মদপুর এলাকায় বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট সংরক্ষণের নিয়ম না মানার অভিযোগে সেবিকা জেনারেল হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড ব্লাড ব্যাংকের মালিক মো. সাখাওয়াত হোসাইনকে সাত লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ড এবং ব্লাড ব্যাংক বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। একই অভিযোগে ফেমাস ডায়াগনস্টিক, কনসালটেন্ট সেন্টার অ্যান্ড ব্লাড ব্যাংককে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। জনসেবা নার্সিং হোম অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিককে করা হয়েছে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা। গত ৩১ আগস্ট পুরান ঢাকার চকবাজারে অভিযান চালিয়ে নকল ও ভেজাল শিশুখাদ্য তৈরির অভিযোগে এক প্রতিষ্ঠানকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করেছে র‌্যাব-১০-এর ভ্রাম্যমাণ আদালত। গত ৩০ আগস্ট হাজী ক্যাম্পে ভেজাল ও ময়লা খাবার সরবরাহের অভিযোগে তিন প্রতিষ্ঠানকে মোট দেড় লাখ টাকা জরিমানা করে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।

অভিযোগ পাওয়া যায়, ক্যাম্পে থাকা হাজীদের মাঝে দীর্ঘদিন ধরে ফ্রিজের রক্ত ও ময়লাযুক্ত খাবার সরবরাহ করে আসছিল কিছু প্রতিষ্ঠান। এর পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকজন হাজী অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ ঘটনায় হাজী ক্যাম্পের ভিতরের তিনটি প্রতিষ্ঠানকে মোট দেড় লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এর মধ্যে সিয়াম এন্টারপ্রাইজের মালিক বশির আলমকে ৬০ হাজার টাকা, কাবাব এন্টারপ্রাইজের মালিক মেজবাহ উদ্দিনকে ৫০ হাজার টাকা এবং পর্ণা এন্টারপ্রাইজকে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। গত ১৯ আগস্ট অবৈধ মোবাইল সিম কার্ডের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, ভেজাল আর নকল পণ্যের ব্যবসা করে অসাধু ব্যবসায়ীরা। তারা অধিক মুনাফার জন্যই বিদেশেও এমন অনৈতিক কাজ করে। আমেরিকাতেও ১৯৩৮ সালে এ ধরনের কর্মকাণ্ড হয়েছিল। পরে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার মাধ্যমে তা থেকে আমেরিকা উত্তরণ ঘটিয়েছে। আমাদের এখানেও বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান টেকনোক্র্যাফদের নিয়ে প্রতিরোধ কমিটি গঠন করতে হবে। যে যেই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তাকে সেখানে বসাতে হবে। সেখানে কোনো আমলা বসালে উন্নতি হবে না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর