রবিবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

আইন মানছে না বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

হয় না সিন্ডিকেট সভা, একাডেমিক কাউন্সিল ও অর্থ কমিটির মিটিং

আকতারুজ্জামান

আইন মানছে না বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

ফ্রিস্টাইলে চলছে বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। উচ্চশিক্ষার বিদ্যাপীঠের অনেকগুলোতেই আইনকানুনের যেন কোনো বালাই নেই। নিয়ম না মানাই যেন কালচার হয়ে দাঁড়িয়েছে কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ অনুযায়ী প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য একটি বোর্ড অব ট্রাস্টিজ থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যাবলি, প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড ও সাধারণ ব্যবস্থাপনা তত্ত্বাবধানের জন্য উপাচার্যের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট গঠিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক একাডেমিক সেক্টর দেখভালের জন্য গঠিত হবে একাডেমিক কাউন্সিল। এরও সভাপতি থাকবেন উপাচার্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেট প্রণয়নে ভূমিকা রাখতে গঠিত হবে অর্থ কমিটি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সূত্র বলছে, নিয়মিত বৈঠকের মাধ্যমে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই করছে না বোর্ড অব ট্রাস্টি ও সিন্ডিকেট সভা, একাডেমিক কাউন্সিল ও অর্থ কমিটির কোনো মিটিং। এতে একদিকে যেমন তারা আইনের লঙ্ঘন করে যাচ্ছে, অন্যদিকে ভেঙে পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনিক চেইন অব কমান্ড। বিনষ্ট হচ্ছে পড়ালেখার সুষ্ঠু পরিবেশ। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও অসহায় হয়ে পড়েছে নিয়ম না মানা এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালগুলোর কাছে। ইউজিসি সূত্র বলছে, দফায় দফায় তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কমিটির কোনো সভা পরিচালনা করছে না। মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আইন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ট্রাস্টি বোর্ড, একাডেমিক কাউন্সিল, সিন্ডিকেট সভা ও অর্থ কমিটির বৈঠক হতে হবে নিয়মিত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন লঙ্ঘন করে এসব সভা করে না। এরা বিশ্ববিদ্যালয়কে সঠিক পথে পরিচালনার চেয়ে অর্থ প্রাপ্তিকেই মুখ্য মনে করে। ইউজিসি চেয়ারম্যান বলেন, অর্থ কমিটির বৈঠক না হলে সেখানে অর্থ নিয়ে নয়-ছয় হবে, এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। সিন্ডিকেট হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী কর্তৃপক্ষ। সিন্ডিকেট না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। এ সভায় সরকার ও মঞ্জুরি কমিশনের প্রতিনিধি থাকবেন। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এ সভা করলেও প্রতিনিধিদের ডাকেন না। ডাকলেও সভার আগের দিন টেলিফোনে বলে থাকেন, যাতে কেউ সেখানে উপস্থিত না হতে পারে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন বলছে, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য একটি বোর্ড অব ট্রাস্টি থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন সমস্যা দূরীকরণসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, অ্যালামনাই এবং সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যক্তিদের সঙ্গে বছরে অন্তত একবার মতবিনিময় সভার আয়োজন করবে ট্রাস্টি বোর্ড। সভায় প্রাপ্ত মতামতের ভিত্তিতে উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হবে। কিন্তু ইউজিসির প্রতিবেদন বলছে, গত বছর পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বোর্ড অব ট্রাস্টির কোনো সভাই হয়নি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (বিএইউইটি), কুইন্স ইউনিভার্সিটি, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ। সূত্রমতে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্যের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট গঠিত হবে। এতে সরকারের মনোনীত একজন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি থাকবেন। সিন্ডিকেটই হবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যাবলি, প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড ও সাধারণ ব্যবস্থাপনা পরিচালনা-তত্ত্বাবধান করবে সিন্ডিকেট। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পরীক্ষা ও ফলাফল অনুমোদন দেবে সিন্ডিকেট। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ২০১৫ সালে ১৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো সিন্ডিকেট সভাই অনুষ্ঠিত হয়নি। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি, ব্রিটানিয়া ইউনিভার্সিটি, জার্মান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (বিএইউএসটি), ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (বিএইউইটি), বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (বিএআইইউএসটি), শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ইউনিভার্সিটি, কুইন্স ইউনিভার্সিটি, রণদাপ্রসাদ সাহা ইউনিভার্সিটি, গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এবং সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। আইন অনুযায়ী শিক্ষার্থী ভর্তি, শিক্ষাদান, শিক্ষা ও পরীক্ষার মান উন্নয়ন এবং তা বজায় রাখতে দায়ী থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক কাউন্সিল। শিক্ষা-সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ে সিন্ডিকেটকে পরামর্শও দেবে তারা। কিন্তু গত বছর ১৩ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক কাউন্সিলের কোনো বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে আহছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (বিএইউএসটি), কুইন্স ইউনিভার্সিটি, পুণ্ড্র ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, ফেনী ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস, শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ইউনিভার্সিটি, রণদাপ্রসাদ সাহা ইউনিভার্সিটি, গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এবং সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ইউজিসি কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয় এক বছরেও যদি কোনো একাডেমিক কাউন্সিলের সভা না করে, তবে একাডেমিক বিভিন্ন খাতে উন্নয়ন সম্ভব নয়। শিক্ষার মান উন্নয়নে সহায়তা করে থাকে একাডেমিক কাউন্সিলের মতামত। ইউজিসি চেয়ারম্যান এ ব্যাপারে বলেন, একাডেমিক কাউন্সিলের যদি বৈঠক না হয়, তবে শিক্ষার মান উন্নয়ন হবে কী করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেট প্রণয়নের দায়িত্ব অর্থ কমিটির। অর্থ কমিটি আর্থিক বিষয়ে সিন্ডিকেট ও বোর্ড অব ট্রাস্টিকে পরামর্শ দেবে এবং সুপারিশ করবে। কিন্তু ১৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গত বছর অর্থ কমিটিরই কোনো বৈঠক করেনি। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকায় রয়েছে চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস, বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি, বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ইউনিভার্সিটি, রণদাপ্রসাদ সাহা ইউনিভার্সিটি, গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুইন্স ইউনিভার্সিটি।

সর্বশেষ খবর