রবিবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

প্রতিদিনই আসছে গোপন পথে রোহিঙ্গা নিয়ে সমস্যা বাড়ছেই

নাফ নদে নৌকায় মিয়ানমার বাহিনীর গুলি

কূটনৈতিক প্রতিবেদক ও কক্সবাজার প্রতিনিধি

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান কোনোভাবেই হচ্ছে না। উল্টো এ সংকট বাড়ছে। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পর মালয়েশিয়া সরকারও জানাল, রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূলের অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিন্তু মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি নিজেদের দায় এড়িয়ে দাবি করেছেন, রোহিঙ্গা সংকট বাড়াচ্ছে আন্তর্জাতিক মহল। অন্যদিকে, বিপদগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের সমস্যা দেখার কেউ নেই। মিয়ানমারে নির্যাতিত হয়ে প্রাণ হাতে নিয়ে নৌকায় উঠে যাচ্ছেন তারা। উত্তাল নাফ নদে ভাসমান নৌকায় মিয়ানমার সেনাদের গুলি চালানোর অভিযোগও উঠেছে। এর পরও রোহিঙ্গারা আসছেন দলে দলে। গতকাল দুটি নৌকায় অন্তত ২২ জনকে ফেরত পাঠিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি। অবশ্য বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে নানান গোপন পথে বেশকিছু রোহিঙ্গা পরিবার গতকালও ঢুকেছে বাংলাদেশে। জানা যায়, ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের তিনটি সীমান্ত পোস্টে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীদের’ হামলায় ৯ সীমান্ত পুলিশ নিহত হওয়ার পর রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত জেলাগুলোয় শুরু হয় সেনা অভিযান। এ ঘটনার পর থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন। বিজিবির টেকনাফ-২ ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক মেজর মো. আবু রাসেল সিদ্দিকী বলেন, নাফ নদের জাদিমুরা পয়েন্ট দিয়ে গতকাল ভোররাতে দুটি নৌকায় অন্তত ২২ জন রোহিঙ্গা প্রবেশের চেষ্টা চালান। এ সময় বিজিবির টহল দলের সদস্যরা জলসীমার শূন্যরেখায় অভিযান চালিয়ে তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছেন। ২১ নভেম্বর থেকে এ পর্যন্ত টেকনাফের নাফ নদের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের বহনকারী ৮৬টি নৌকা অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিজিবির কক্সবাজার ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইমরান উল্লাহ সরকার বলেন, গতকাল ভোররাতে বিজিবির টহল দল সীমান্তের উখিয়ার বালুখালী পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে দুই রোহিঙ্গা নারীকে ফেরত পাঠিয়েছে।

অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় আরও ৫০ হাজার মানুষ : মিয়ানমারে অমানবিক নির্যাতনের শিকার প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু সে দেশের সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে। ইতিমধ্যে অনুপ্রবেশকারী হাজারো রোহিঙ্গা আশ্রয়হীন অবস্থায় উখিয়ার কুতুপালং বস্তিতে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। গতকাল সকালে কুতুপালং বস্তি এলাকা ঘুরে দেখা যায় বস্তির ঝুপড়ি ঘরের আনাচে কানাছে আশ্রয় নেওয়া বেশকিছু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী নারী-পুরুষ-শিশু। তাদের চোখেমুখে ক্লান্তি ও বিষাদের ছাপ। জানতে চাইলে মংডু নাইছংপাড়া গ্রামের শামসুল আলম (৩৫) জানান, তার স্ত্রী হাসিনা (২৮), মেয়ে শাহিনা (৭), ছেলে কাউসার (৪) ও সোহেলকে (২) নিয়ে দুই দিন ধরে বস্তির ঝুপড়ি ঘরের আঙিনায় দিন কাটাতে হচ্ছে। এক কাপড়ে চলে আসায় শীত নিবারণ করতে না পারায় ঠাণ্ডায় তার দুই শিশু জ্বরে কাঁপছে। যাদের আত্মীয়-পরিজন আছে, চেনাজানা রোহিঙ্গা পরিবার রয়েছে তারা আশ্রয় পেলেও হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা পরিবার তার মতো খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছে।

রোহিঙ্গাদের পক্ষে মিছিল করবেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী : রোহিঙ্গাদের প্রতি সংহতি জানিয়ে আজ মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে একটি মিছিলের পরিকল্পনা করা হয়েছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক ও তার সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা এ মিছিলে উপস্থিত থাকবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। গতকাল মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা তাদের জাতিগতভাবে নির্মূলের একটি চেষ্টা। এ কাজ এখনই বন্ধ করতে হবে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হবে। রোহিঙ্গা ইস্যুর কারণে মালয়েশিয়ার নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে বলে বিবৃতিতে বলা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, মালয়েশিয়া ও অন্যান্য প্রতিবেশী দেশে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার উপস্থিতি বিষয়টিকে একটি ‘আন্তর্জাতিক ইস্যুতে’ পরিণত করেছে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চালানো দমন-পীড়নের বিষয়ে প্রতিবাদ জানাতে গত সপ্তাহে মালয়েশীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল।

নাফ নদে রোহিঙ্গা নৌকায় মিয়ানমার বাহিনীর গুলি : নাফ নদে রোহিঙ্গা বোঝাই একটি নৌকায় নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)। বুধবার রাতে গুলিবর্ষণের ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ইমান হোসেন (৪৮) নামে এক রোহিঙ্গাকে নাফ নদ থেকে উদ্ধার করেছেন স্থানীয় জেলেরা। তবে তার ছেলেসহ নৌকায় থাকা ৪২ নারী-পুরুষ-শিশুর ভাগ্যে কী ঘটেছে, জানা যায়নি।

গতকাল লেদা ক্যাম্পে ইমান হোসেনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাখাইন রাজ্যের মংডু পেরামপুরু চর এলাকায় প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গা বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় ছিলেন। পরে রোহিঙ্গা বোঝাই করে ছয়টি নৌকা টেকনাফ সীমান্তের দিকে রওনা হয়। এর কিছুক্ষণ পর অন্য একটি নৌকায় ইমান হোসেন তার দুই ছেলে সেলিম উল্লাহ(১৮) ও সালামত খাঁ (১৪)-সহ প্রায় ৪২ জনের মতো লোক টেকনাফের উদ্দেশে রওনা হন। কিছু দূর আসার পর হঠাৎ বিজিপির একটি স্পিডবোট গুলি করতে করতে তাদের ধাওয়া করে। বিজিপি নৌকায় নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করলে প্রাণ রক্ষায় যে যেদিকে পারেন ঝাঁপ দেন। অনেকে নৌকায় রয়ে যান। ইমান হোসেন প্রায় দেড় ঘণ্টা সাঁতরিয়ে মাঝামাঝি চলে আসেন এবং বাঁচার জন্য চিৎকার করতে থাকেন। একপর্যায়ে কেরুনতলীর আবদুস সালামের মাছ ধরার একটি নৌকা তার চিৎকার শুনে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। আবদুস সালাম জানান, তাদের নৌকাটি বড়শি দিয়ে মাছ শিকার করছিল। চিৎকার শুনে তাকে উদ্ধার করেন। ইমান হোসেন জানান, বিজিপি পোস্টে হামলার তিন দিন পর তাদের ওয়াবেক গ্রামে হামলা চালায় সেনারা। এ সময় তিনি স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানকে গ্রামে রেখে বড় দুই ছেলেকে নিয়ে পাহাড়-জঙ্গল, খাল-বিলে পালিয়ে ছিলেন। শেষে সে দেশের ঘাইট্যাকে (দালাল) সাড়ে ৩ লাখ কিয়েট (মিয়ানমারের মুদ্রা) দিয়ে পেরামপুরু থেকে নৌকায় ওঠেন। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। দুই ছেলেকে হারিয়ে দিশাহারা ইমান হোসেন। স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের অন্যদের সঙ্গেও যোগাযোগ নেই তার।

সর্বশেষ খবর