মঙ্গলবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

মৃতরাও পাচ্ছে বয়স্ক ভাতা

মাহবুব মমতাজী

মৃতরাও পাচ্ছে বয়স্ক ভাতা

মনিকা বেগম

দেশের সুবিধাবঞ্চিতদের সামাজিক নিরাপত্তার জন্য চালু করা বয়স্কভাতার ওপর হাত বসিয়েছে কিছু দুর্বৃত্ত। তারা ছলচাতুরি করে হাতিয়ে নিচ্ছেন অসহায় প্রবীণদের ভাতা। এমনকি মৃতদের ভাতা পর্যন্ত তুলে খাচ্ছে এই সংশ্লিষ্ট দুর্বৃত্তরা। আর এই অনিয়ম ও প্রতারণা হচ্ছে সমাজসেবা অধিদফতরের স্বচ্ছতা আর জবাদিহিতার অভাবে। জানা গেছে, নিবন্ধিত ব্যক্তি যিনি মারা গেছেন তার নামে বরাদ্দকৃত ভাতা চালু রাখা হয়েছে। মৃত্যুর পরেও সেই টাকা বইতে জমা হয় এবং তা অধিদফতরে কখনো ফেরত যায়নি। এমনকি তা হালনাগাদ করেনি কর্তৃপক্ষ। অনেক ভুয়া নামে অর্থাৎ ব্যক্তির অস্তিত্ব সুনির্দিষ্ট ঠিকানায় না থাকলেও তাদের লিপিবদ্ধ করা হয়েছে আর্থিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে। অন্যদিকে বছরের পর বছর এ বয়স্কভাতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অনেক সুবিধাবঞ্চিত মানুষ। সারা দেশে ৩১ লাখ ৫০ হাজার মানুষ বয়স্কভাতা পান। তাদের মাসে ৫০০ করে বছরে ৬ হাজার টাকা দেওয়া হয়। নতুন করে প্রায় ২১ লাখ ৫৫ হাজারের ডাটাবেজ তৈরি করা হচ্ছে। অভিযোগ পাওয়া যায়, পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায় শহর সমষ্টি উন্নয়ন প্রোগ্রাম-১ (ইউসিডি) এর আওতায় দেড় বছর ধরে ভাতা নেন মনিকা বেগম। তার ঠিকানা দেওয়া আছে যাত্রাবাড়ীর মিরহাজির বাগের ১২২ নম্বর বাসা। কিন্তু ওই ঠিকানায় এই নামে কোনো ব্যক্তির হদিস নেই। ওই নামের এক বৃদ্ধা থাকলেও তার মৃত্যু হয়েছে বছর খানেক আগে। পশ্চিম ধোলাইপাড়ের ৪৫ নম্বর বাড়ির ৯৮ বছর বয়সের আনোয়ারা বেগমকে দেওয়া হয়েছে বয়স্কভাতা। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ঠিকানায় যোগাযোগ করেও পাওয়া যায়নি ওই নামের কাউকে। পূর্ব ধোলাইপাড়ের ২১৮/১ নম্বর বাড়ির ৮২ বছর বয়সী বিলকিস বেগমের নামেও পাঠানো হয় বয়স্কভাতার টাকা। তার বিষয়ে বাড়ির মালিক আবু মুসা বলেন, আগেও এ নামে এখানে কেউ ছিল না। এখনো নাই। ভাতা নেওয়া ৬৫ বছর বয়সী মো. ইউনূছের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে ১০/২ মীরহাজিরবাগে। এর পাশের বাড়ির মালিক মো. আবদুল মোত্তালেব তার বিষয়ে জানান, ইউনূছ নামের কেউ এখানে কখন ছিল না। বিগত দিনেও এ নামের কোনো ব্যক্তি আমাদের এখানে বাসা ভাড়া নেননি। অভিযোগ রয়েছে, গেন্ডারিয়া এলাকার জয়তুন নেছা, মমতাজ বেগম ও নুরুদ্দিন নামের কেউ বেঁচে না থাকলেও তাদের দেওয়া হয় ভাতার টাকা। তাদের মতো আরও অনেকের নাম ভাঙিয়ে টাকা তুলে খাচ্ছেন লাইলি নামে এক নারী। যাকে সংশ্লিষ্ট এলাকার ইউসিডি কার্যালয়ের পিয়ন আবেদ সহায়তা করেন। এমনকি স্থানীয় ওয়ার্ডের কাউন্সিলররাও এর সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ নূর হোসেন জানান, বয়স্কভাতার কার্ড বছরে আমাদের জন্য ৫-৬টিও বরাদ্দ থাকে না। সমাজসেবার স্থানীয় প্রতিনিধিরা বছরে একবার তাদের জোনাল অফিসে মিটিং করেন সেখানে উপস্থিত পছন্দের ব্যক্তিদের ফরম দেওয়া হয়। যতটা মনে হয় এক্ষেত্রে ভেজাল আছে। জানা গেছে, মাঠপর্যায়ে কাজের গাফিলতির কারণে অনেক অসহায় মানুষ সরকারি সুযোগ-সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ ধরনের বঞ্চনার শিকার হয়েছেন পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার সাহাপুর ইউনিয়নের বাবুলচরা গ্রামে দুই বৃদ্ধা। তাদের একজন এলেজা বেগম। বয়স ১০৪ বছর। আরেকজন ডলি বেগমের বয়স ৯৪ বছর। জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও তারা পাননি বয়স্কভাতার সুবিধা। অনেকটা আক্ষেপ করে তারা বলেন, আমাদের আর কত বয়স হলে ভাতা পাব জানি না। আশপাশে দেখি আমাদের বাচ্চাদের কমবয়সীরা ভাতা পায়। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার মাছখোলা গ্রামের আহমদ আলী গাজীর ১০৭ বছর বয়সে এসেও তার কপালে জোটেনি বয়স্কভাতার কার্ড। এর জন্য তিনি স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কাছে একাধিকবার ধরনা দিয়েছেন। কোনো কাজ হয়নি। গাজী প্রশ্ন রেখে বলেন, আর কত বয়স হলে আমি ভাতা পাবো? শেষ বয়সে যদি ভাতা পেতাম তাহলে একটু সুখে শান্তিতে থাকতে পারতাম। মৃত ব্যক্তিদের নামে বয়স্কভাতা বহাল রাখার বিষয়ে সমাজসেবা অধিদফতরের মহাপরিচালক গাজী মো. নুরুল কবিরের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বলেন, যারা ভাতা পায় টাকা তাদের বইতে চলে যায়। গ্রামগঞ্জে এ ধরনের হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ সেখানে সবাই সবাইকে চেনে। তবে শহরে যারা থাকে সাধারণত তারা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত থাকে না। তাই শহরে কিছু হলেও হতে পারে। বয়স্কভাতা প্রাপ্তদের তালিকা হালনাগাদের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের ডাটাবেজে সবার তালিকা করা আছে। এর মধ্যে কিছু ওয়েটিং তালিকাও আছে। যখন ভাতা পাওয়া কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হয় তখন ওয়েটিং থেকে মূল তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর