বুধবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বেপরোয়া স্টেশনারি অফিস, নীরব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়

নিজস্ব প্রতিবেদক

বেপরোয়া স্টেশনারি অফিস, নীরব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়

সরকারি অর্থ লুটপাটে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকা বাংলাদেশ স্টেশনারি অফিস। সরকারের এ প্রতিষ্ঠানটি বিএসটিআইর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই দেড় লাখ রিম বিদেশি কাগজ কেনার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছে, যা আমদানি নীতিমালা অনুযায়ী নিষিদ্ধ। স্টেশনারি অফিসের একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে অর্থ লুটপাটের এ আয়োজন সম্পন্ন হতে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।

জানা গেছে, বিদেশি কাগজ কেনার নামে বিশ্বমানের দেশীয় উন্নত কাগজশিল্প ধ্বংসের গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত চক্রান্তকারীদের সঙ্গে আঁতাত করেছেন স্টেশনারি অফিসের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা। ‘এ-ফোর’ সাইজের সাদা অফসেট বিদেশি যে কাগজ খোলা বাজারে প্রতি রিম ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়, তা ৪২৯ টাকায় কিনতে যাচ্ছে স্টেশনারি অফিস। যদিও দেশে উৎপাদিত একই মানের খুব ভালো ব্র্যান্ডের কাগজ প্রতি রিম বিক্রি হয় ২৫০ টাকায়। আর এভাবেই একদিকে সরকারের কোটি কোটি টাকা লুটপাট, অন্যদিকে বিশ্বমানের উন্নত কাগজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশি শিল্প ধ্বংসের চক্রান্তকারীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে স্টেশনারি অফিস।

সূত্রমতে, স্টেশনারি অফিস প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নাম ভাঙিয়ে বিদেশি কাগজ কিনতে যাচ্ছে। বিদেশি কাগজের শর্তারোপ করে ইতিমধ্যে দুটি টেন্ডারও (দরপত্র) আহ্বান করেছে তারা। প্রতিষ্ঠানটির কিছু অসাধু কর্মকর্তা স্থানীয় এজেন্টদের সঙ্গে যোগসাজশ করে বিদেশি কাগজ কেনায় তৎপর রয়েছে। আর এ প্রক্রিয়ায় সরকারের ১ কোটি ৭৪ লাখ টাকা লুটপাটের আয়োজন করা হয়েছে। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে স্টেশনারি অফিস কর্তৃপক্ষ কাগজ কেনার প্রক্রিয়াটি ই-টেন্ডারের আওতার বাইরে রেখেছে। ই-টেন্ডারের মাধ্যমে এ কাগজ কেনা হলে অনেক প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নিতে পারত। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বর্তমানে একই মালিকানার পৃথক নামের দুটি প্রতিষ্ঠান এম এইচ এন্টারপ্রাইজ ও এফ এফ এন্টারপ্রাইজ এ টেন্ডারে অংশ নিয়েছে। জানা গেছে, আমদানিনীতি অনুযায়ী পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) অনুমোদন ছাড়া কোনো পণ্য আমদানি ও বাজারজাত করা নিষেধ। তার পরও সরকারি দফতর স্টেশনারি অফিস কর্তৃপক্ষ এ আইনের তোয়াক্কা না করে বেআইনিভাবে বিদেশি কাগজ কিনছে। এমন প্রেক্ষাপটে দেশি কাগজশিল্প উদ্যোক্তারা মনে করেন, স্টেশনারি অফিসের কর্মকর্তাদের ওপর দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কার্যকর নজরদারি প্রয়োজন। তথ্যমতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য উন্নতমানের ‘এ-ফোর’ সাইজের সাদা অফসেট বিদেশি কাগজ কিনতে দরপত্র বিজ্ঞপ্তি আহ্বান করে বাংলাদেশ স্টেশনারি অফিস। ২৫ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠানটির উপপরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত দরপত্র বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ১ লাখ ৫০ হাজার রিম বিদেশি ‘ডাবল-এ’ বা সমমানের ব্র্যান্ডের কাগজ রাজস্ব খাতের অর্থায়নে কেনা হবে। পরদিন আরেক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আরও ২০ হাজার রিম বিদেশি ‘ডাবল-এ’ বা সমমানের ব্র্যান্ডের কাগজ কেনা হবে। জানা গেছে, দেশে যে পরিমাণ কাগজের চাহিদা রয়েছে তার দ্বিগুণ উৎপাদনের ক্ষমতা আছে দেশি কাগজ মিলগুলোর। উৎপাদিত কাগজ বিশ্বমানের হওয়ায় তা রপ্তানিও হচ্ছে। তবুও আমদানি করা হচ্ছে বিপুল বিদেশি কাগজ। দেশি উদ্যোক্তারা বলছেন, আমদানি করা বেশির ভাগ কাগজ নিম্নমানের। সরকারি টাকা আত্মসাতের জন্যই চড়া মূল্যে বিদেশি কাগজ কেনা হচ্ছে। অথচ দেশে উৎপাদিত উন্নতমানের কাগজ কিনছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, টাঁকশাল, পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বিভিন্ন দেশের দূতাবাস, বহুজাতিক করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। সেখানে সরকারের স্টেশনারি অফিসের বিদেশি কাগজ কেনার উদ্যোগে স্থানীয় বিকাশমান কাগজশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি হুমকির মুখে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ স্টেশনারি অফিসের উপপরিচালক মো. হামিদুল হক সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আসলে মন্ত্রণালয়ের ব্র্যান্ডিং চাহিদা থাকে কিছু। তারা ‘ডাবল এ’ বা ‘পেপার ওয়ান’ নামের কাগজ চায়। আমরা নিজের চাহিদায় কোনো কাগজ কিনি না। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বলে দেয় যে, ডাবল এ বা পেপার ওয়ান কাগজ লাগবে। আমিও জানি দেশে অনেক ভালো কাগজ তৈরি হয়। আমরা এর আগেও কিনেছি। দেশে অনেক ভালো ব্র্যান্ডের কাগজ আছে। কিন্তু আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। আমরা তো অন্যের চাহিদার ভিত্তিতে কিনি, এটাই সমস্যা। তবে বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএমএ) সচিব এ কে এম নওশেরুল আলম বলেন, দেশের কাগজশিল্প এখন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ খাত। ছোট-বড় শতাধিক কাগজ কারখানা আছে। এগুলো বছরে ১৪ লাখ টন কাগজ উৎপাদনে সক্ষম। দেশে উৎপাদিত সব ধরনের কাগজই আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। এমনকি দেশের পুরো চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। আমাদের সদস্য কারখানাগুলো বিশ্বের ২৫-৩০টি দেশে বিভিন্ন জাতীয় কাগজ ও কাগজজাত পণ্য রপ্তানি করছে। তিনি বলেন, সরকার যেখানে দেশি শিল্প সুরক্ষার চিন্তা করছে, সেখানে সরকারি একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্টেশনারি অফিস কী উদ্দেশ্যে বিদেশি কাগজ আমদানি উৎসাহিত করতে তাদের টেন্ডার (দরপত্র) আহ্বান করেছে, তা আমাদের বোধগম্য নয়। আমরা যে মেশিন ও উপকরণ বা কাঁচামাল দিয়ে কাগজ উৎপাদন করি, বিদেশিরাও তাই করে। দেশে উৎপাদিত কাগজ অনেক ক্ষেত্রে বিদেশি কাগজের চেয়ে উন্নত। সরকারের অনেক প্রতিষ্ঠান যেমন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, ইউনিলিভার, বিভিন্ন দূতাবাসও দেশি কাগজ কিনছে। সেখানে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান বিদেশি কাগজ প্রোমোট (উৎসাহিত) করছে, যা রহস্যজনক। সরকার যেখানে শিল্পায়নের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে এবং ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হতে কাজ করছে, সেখানে দেশি শিল্প ধ্বংসের একটি প্রচেষ্টা এটি। তার পরও আমরা আশা করব, ওই প্রতিষ্ঠানটি কোনো সুনির্দিষ্ট বিদেশি কাগজ উল্লেখ না করে, মানের প্রতিযোগিতা করতে দেশি-বিদেশি সবাইকে সমান সুযোগ দেবে। জানা গেছে, অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ, ব্যাংকের চড়া সুদ, অবকাঠামো সমস্যাসহ বিভিন্ন অসুবিধার কারণে এমনিতেই দেশে কাগজ উৎপাদনে খরচ বেশি। দেশের চালু কাগজকলগুলোর উৎপাদনক্ষমতা বছরে প্রায় ১৪ লাখ টন হলেও চাহিদা ৬ থেকে ৮ লাখ টন। সে হিসেবে দেশে বছরে ৪-৫ লাখ টন কাগজ উৎপাদনক্ষমতা অব্যবহূত থেকে যাচ্ছে। দেশের কাগজশিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ১৪ লাখ মানুষের জীবিকা। এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। উদ্যোক্তাদের আশঙ্কা, বিদেশি কাগজে দেশ সয়লাব হয়ে গেলে এ খাতে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বিপন্ন হবে।

সর্বশেষ খবর