শনিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

নতুন নেতৃত্বে প্রয়োজন প্রবীণদের প্রণোদনা

চট্টগ্রামে তারুণ্যের রাজনীতি

রিয়াজ হায়দার, চট্টগ্রাম

নতুন নেতৃত্বে প্রয়োজন প্রবীণদের প্রণোদনা

আওয়ামী লীগে প্রতিকূলতার জয় আর বিএনপিতে নিছক পারিবারিক উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠার নজিরে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে তরুণ নেতৃত্ব এখনো অনিশ্চিত গন্তব্যে। দুই বড় জোটেই আছে মাঠের ত্যাগকে উপেক্ষা করে পুঁজিপতি-ব্যবসায়ী আর পেশিশক্তির মূল্যায়ন। চাটগাঁর ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব মাদক ব্যবসা, বিলবোর্ড দখলবাজ, টপ-টেরর আর অযাচিত কিংবা ‘অপাত্রে ঘি ঢালা’র মতো পারিবারিক উত্তরাধিকারের ঘেরাটোপেই আবদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এমন অবস্থায় আশাহত রাজনীতি সচেতন চট্টগ্রামের মানুষ তাকিয়ে আছেন প্রবীণ ও দায়িত্বশীল শীর্ষ নেতাদের দিকেই। তাদের মতে, নতুন নেতৃত্বের বিকাশে ভূমিকা রাখতে পারেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মহানগর সভাপতি সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, বর্ষীয়ান নেতা গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এবং মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনসহ দায়িত্বশীলরা। অভিন্ন লক্ষ্যে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটেও প্রয়োজন যথার্থ প্রণোদনা। আওয়ামী লীগে ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মত বর্তমান সভাপতি শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের নতুন নেতৃত্বের পদায়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু যেমন প্রাদেশিক পরিষদে ডা. এম এ মান্নান, আবদুল্লাহ আল হারুন, ডা. ফয়েজুর রহমান কিংবা জাতীয় পরিষদে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত তরুণ আতাউর রহমান খান কায়সার, মির্জা আবু মনসুর ও এম এ মান্নান, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন প্রমুখকে মনোনয়ন দেন তেমনি ২০০৮ এবং সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন এবং সিটি করপোরেশন নির্বাচন, এমনকি আঞ্চলিক ও কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্বীকৃতি পেয়েছেন নতুনেরা। শহরের রাজনীতিতে ‘বাবু-মহিউদ্দিনে’র দীর্ঘকালীন প্রভাবের কালে প্রতিকূলতা মাড়িয়েই দল ও প্রশাসনে ঠাঁই পেয়েছেন অপেক্ষাকৃত নবীন নেতা মেয়র আ জ ম নাছিরউদ্দিন। অন্যদিকে দক্ষিণ জেলার সন্তান হিসেবে দল ও সরকারে স্বীকৃতি মিলেছে বাবুপুত্র সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, কায়সার কন্যা ওয়াসিকা আয়েশা খান এমপি, আমিনুল ইসলাম, মফিজুর রহমান, ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া প্রমুখের। এরও আগে উত্তর চট্টলার সন্তান ড. হাছান মাহমুদ মন্ত্রিপরিষদ ও কেন্দ্রের পদ পান মহানগর থেকে সম্প্রতি মহিউদ্দিনপুত্র ব্যারিস্টার চৌধুরী মহিবুল হাসান নওফেলের কেন্দ্রীয় স্বীকৃতি জোটে। কিন্তু স্বীকৃতি মেলেনি অ্যাডভোকেট ইব্রাহীম হোসেন চৌধুরী বাবুল, রেজাউল করিম চৌধুরী, খোরশেদ আলম সুজন কিংবা উত্তর চট্টগ্রামের গিয়াসউদ্দিন আর দক্ষিণের মাঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরী, শাহাজাদা মহিউদ্দিন প্রমুখের। গেল পাঁচ দশকের পথযাত্রায় এম এ আজিজ-জহুর আহমদ চৌধুরীর চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগে শুধু পারিবারিক উত্তরাধিকার কিংবা যুগপৎ বৃত্ত ও পেশিশক্তির প্রভাব না থাকায় রাজনীতির মাঠ থেকে হারিয়ে গেছেন সাবেক ছাত্র ও যুবনেতাদের অনেকেই। এমনটি জানান চট্টগ্রামের পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ সভাপতি ও বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের বারে বারে নির্বাচিত নেতা ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের প্রভাব, মাঠের কাজের মূল্যায়ন না হওয়ায় শিক্ষিত ত্যাগীদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলা এবং প্রবীণ নেতাদের উপযুক্ত পরিচর্যার অভাবে নতুন নেতৃত্বের পর্যাপ্ত বিকাশ হয়নি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, প্রত্যেক প্রকল্প কাজের মতো রাজনীতিতেও সাফল্যের লক্ষ্যমাত্রা থাকতে হয়। ধর্মীয় ও আঞ্চলিক বৈষম্য কাটিয়ে শিক্ষা, ত্যাগ ও নিবেদিত ভূমিকার মূল্যায়ন করে নতুনদের ‘প্রমোট’ করা না গেলে আগামীর নেতৃত্ব ঝুঁকির মুখে পড়বে।’ চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. প্রভাত চন্দ্র বড়ুয়া বলেন, ‘তারুণরাই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে জানে। তরুণদের মেধা, শ্রম ও দায়িত্বশীলতার সাথে প্রবীণদের অভিজ্ঞতার সঠিক সংযুক্তি ঘটাতেই উদার মানসিকতা নিয়ে নবীনদের প্রণোদনা দিতে হবে।’ অভিন্ন লক্ষ্যে শুধুই পারিবারিক উত্তরাধিকার নয়, সাংগঠনিক ও আদর্শিক উত্তরাধিকারেরও যথার্থ স্বীকৃতি প্রয়োজন বলে মনে করেন মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ নাসিরুদ্দিন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামে বহুদিন ধরে নতুন নেতৃত্বের ক্ষেত্র তৈরির পথটি সহজ ছিল না। যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে নেতৃত্বের অনেক সম্ভাবনায় চাপা পড়েছিল। শহরে মেয়র নাছির, উত্তরে এম এ সালাম কিংবা দক্ষিণ জেলায় প্রতিমন্ত্রী জাবেদের উত্থানের মধ্য দিয়ে যে নতুন জয়যাত্রা শুরু, যা ধরে রেখে সুফলটা ঘরে রাখতেই নতুন নেতাদের দায়বদ্ধতার পাশাপাশি প্রবীণ নেতা মোশাররফ-মহিউদ্দিনের সহযোগিতাও জরুরি। এদিকে, বিএনপির অবস্থা আরও শোচনীয়। অভ্যন্তরীণ কোন্দলের প্রকোপ আর মাঠের রাজনীতির মূল্যায়ন না হওয়ার মহানগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন, তরুণ নেতা আবু সুফিয়ান, মোশাররফ হোসেন দীপ্তিসহ দু’চারজন ছাড়া বেশির ভাগ তরুণকেই নিছক পারিবারিক ব্যবসায়িক উত্তরাধিকার রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। প্রায় চার দশকের বিএনপির রাজনীতিতে চট্টগ্রামে এখন প্রবীণ নেতা, সাবেক মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমান প্রজন্মের যেন বিদায়ের কাল। যথার্থ মূল্যায়ন না হলেও এখনো মাঠে তারই হুঙ্কার কর্মীদের প্রাণিত করছে। নোমানপুত্র সাঈদ আল নোমান রাজনীতিতে তেমনটা আগ্রহী নন, শিক্ষা বিস্তারেই সক্রিয়। তবুও স্বজন-শুভার্থীরা স্বপ্ন দেখছেন সাঈদকে ঘিরেই। অন্যদিকে, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মীর মোহাম্মদ নাছিরউদ্দিন মধ্যাহ্নের কড়া রোদের বদলে পড়ন্ত বিকালে রাজনীতির মাঠের চেয়ে নাতি হামজা-দানিয়ালের সঙ্গে সখ্যতায় বেশি সুখ পান। সঙ্গত কারণেই তার সংসদীয় আসন হাটহাজারীতে পুত্র ব্যারিস্টার মীর হেলালই তত্পর। অন্যদিকে মহানগরে দলীয় বিভক্তিতে হতাশা আর মামলা-হুলিয়া অঘটন আশঙ্ক্ষা নিয়ে এম এ সবুর, কাজী আকবর, এরশাদ উল্লাহসহ অনেক সম্ভাবনাময় নেতাই চুপসে গেছেন। উত্তর জেলার যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পুত্র হুম্মাম কাদের চৌধুরী দলের কেন্দ্রীয় পদ পেলেও সাবেক হুইপ সৈয়দ ওয়াহিদুল আলমের কন্যা ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা পাননি স্বীকৃতি। এ ছাড়া দক্ষিণ জেলা এই স্বীকৃতি বঞ্চনা আরও পুরনো। দক্ষিণের অধ্যাপক শেখ মহিউদ্দিন আর উত্তরের চাকসু ভিপি নাজিম যেন বৃহৎ এই দলটিতে মাঠের নেতৃত্ব অবমূল্যায়ন হওয়ার নিকট উদাহরণ। এমন নানাভাবে বঞ্চনার শিকার হওয়া তরুণ নেতৃত্ব আওয়ামী লীগ-বিএনপি দু-ধারাতেই সংগ্রাম করছেন টিকে থাকার। তাদের অনেকের মতে, দলের প্রতি নিষ্ঠা আর ত্যাগের যথার্থ মূল্যায়ন না করে নিছক পারিবারিক উত্তরাধিকারের স্বীকৃতি আর বিত্ত-বৈভবের জয়-জয়কার হলে ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও নেতৃত্ব দখলবাজ আর মাদক ব্যবসায়ী বিত্তবান ও গুটি কটি পরিবারেই সংকুচিত হয়ে থাকবে। এর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা বাস্তবায়ন আর গণমানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনের রাজনীতির জয় হবে না।

সর্বশেষ খবর