রবিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

সব নির্বাচন হয় হয় না ডাকসু

ফরহাদ উদ্দীন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর শিক্ষক সমিতি, কর্মকর্তা, কর্মচারী সংগঠনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। হয় না শুধু ডাকসু নির্বাচন। ঢাবি পরিবারের অন্য সদস্যরা সাংগঠনিক কার্যক্রমের মাধ্যমে অধিকার আদায় করে নিলেও ডাকসু অকার্যকর থাকায় শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত  এসব হচ্ছে অধিকার থেকে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আন্দোলনের নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে ছাত্র রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) থেকে। কিন্তু দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে নির্বাচন নেই দেশের দ্বিতীয় পার্লামেন্ট খ্যাত এই রাজনৈতিক সূতিকাগারে। ঢাবির বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও ছাত্র নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। ’৯০-এর পরে গণতান্ত্রিক সরকারের শাসনামলের দীর্ঘ ২৬ বছরে হয়নি এ নির্বাচন। সরকারের কর্তৃত্ব হারানোর ভয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সরকারের প্রতি মেরুদণ্ডহীন আনুগত্যের কারণে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পরেও সচল হচ্ছে না ডাকসু। ফলে স্থবিরতা বিরাজ করছে ছাত্র রাজনীতিতে, গড়ে উঠছে না মেধাবী ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব এবং শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে ন্যায্য অধিকার থেকে। সবাই মুখে ডাকসু সচল করার দাবি জানালেও প্রকৃতপক্ষে তা বাস্তবায়নে কেউই সক্রিয় নয়। বিশেষ করে ছাত্র সংগঠনগুলো ডাকসু নির্বাচনের কথা বললেও কাউকে মাঠে নেমে আন্দোলন করতে দেখা যায়নি। বরং কিছুসংখ্যক সাধারণ শিক্ষার্থী নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চ। তবে নানা প্রতিকূলতার কারণে তাদের আন্দোলন সফল হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে ডাকুস অকার্যকর থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র সংগঠনগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রম নেই। ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাস ও হলে আধিপত্য বিস্তার করছে। শিক্ষার্থীদের বাধ্য হয়ে অপরাজনীতি করতে হচ্ছে। মেধাবীরা ছাত্র রাজনীতি বিমুখ হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে পাঁচজন ছাত্র প্রতিনিধি থাকার নিয়ম থাকলেও ডাকসু না থাকায় তা শূন্য রয়েছে। ফলে শিক্ষা কার্যক্রমে ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব নেই। তাদের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই। ফলে প্রশাসন ছাত্রদের মতামত ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করছে যা শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বাধাগ্রস্ত করছে। ডাকসু কার্যকর না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান কমছে দিন দিন। ঠিকমতো গবেষণা হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব র্যাংকিংয়ে পিছিয়ে পড়ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে অপরাজনীতির শিকার হয়ে যারা মৃত্যু বরণ করেছে তার বিচার হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনগুলোতে খাবারের নিম্নমান ও অযৌক্তিকভাবে প্রশাসন বেতন-ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদ করার কেউ নেই। হচ্ছে না আগের মাতো এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিস বা সহ-শিক্ষা কার্যক্রম।

এদিকে ডাকসু অকার্যকর থাকলেও থেমে নেই ছাত্র সংসদের নামে ফি আদায়। প্রতিবছর ছাত্র সংসদের নামে আদায় করা হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভর্তি হওয়ার সময় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদ বাবদ মোট ১২০ টাকা করে আদায় করা হয়। এ খাতে প্রতিবছর প্রায় ৪০ লাখ টাকা আয় করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

নিয়ম অনুযায়ী ডাকসুর নির্বাচিত ভিপি ও জিএসের স্বাক্ষর ছাড়া এ খাতের টাকা উত্তোলন করা যায় না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে এই টাকা প্রতিবছর শিক্ষার্থীদের কল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা হয়। এ খাতে আদৌ টাকা জমা আছে কিনা তা প্রশাসনের কেউ জানে না।

ছাত্রলীগ ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন প্রিন্স বলেন, ছাত্রলীগ সব সময় ডাকসু নির্বাচনের পক্ষে। ঢাবি হচ্ছে গণতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি চর্চার প্রাণকেন্দ্র। এই চর্চাকে অব্যাহত রাখার জন্য ডাকসু নির্বাচন হওয়া আবশ্যক।  ছাত্র ইউনিয়নের ঢাবি শাখার সভাপতি তুহিন কান্তি দাস বলেন, সরকার কর্তৃত্ব হারানোর ভয়ে কখনো চায় না ডাকসু নির্বাচন হোক। এ ছাড়া ডাকসু নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাসে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে না। আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সরকারের অনুগত হওয়ায় নির্বাচন নিয়ে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করে না। ঢাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, অনেক বছর ধরে ডাকুস কার্যকর না থাকার কারণে নির্বাচন নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। নীতিগতভাবে আমি চাই ডাকসু নির্বাচন হোক। নির্বাচন হলে অনেক ভালো নেতৃত্ব উঠে আসবে।

শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চের মুখপাত্র নূর বাহাদুর বলেন, সব শিক্ষার্থীই ডাকসু নির্বাচন চায়। কিন্তু এটি নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে ও আন্দোলন করতে তারা ভয় পায়। কারণ আন্দোলন করলে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন তাদেরকে হল থেকে বের করে দেবে এবং অনেক সময় তাদের ক্যাম্পাসে চলাফেরা করাটাও অসম্ভব হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, ডাকসু নির্বাচনের জন্য সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অনেকগুলো উপাদানের প্রয়োজন হয়। এই উপাদানসমূহের মধ্যে সমন্বয় না হলে নির্বাচন দেওয়া সম্ভব হয় না।

সর্বশেষ খবর