রবিবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বীমা খাতে তলে তলে লুটপাট

আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে সমঝোতা চায় বিআইএ

রুহুল আমিন রাসেল

বীমা খাতে তলে তলে লুটপাট

দেশে জীবন বীমা ও সাধারণ বীমা খাতের নতুন এবং পুরনো কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা খরচের নামে চলছে তলে তলে লুটপাট। ফলে দুরবস্থার যেন শেষ নেই। বীমা খাতে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা ও অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা খরচে জটিলতা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, চলমান সংকট উত্তরণে আইনি প্রক্রিয়ার বাইরেই সমঝোতার তাগিদ বীমা কোম্পানি মালিকদের। তথ্য সংশ্লিষ্ট সূত্রের। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) তথ্যমতে, রাষ্ট্রায়ত্ত জীবন বীমা করপোরেশন ও সাধারণ বীমা করপোরেশনসহ দেশে মোট ৭৭টি জীবন (লাইফ ইন্সুরেন্স) এবং অ-জীবন (নন-লাইফ ইন্সুরেন্স) বীমা প্রতিষ্ঠান আছে। বর্তমানে বেসরকারি খাতের ৭৫টি কোম্পানির মধ্যে ৩০টি জীবন ও ৪৫টি অ-জীবন। এর মধ্যে ২০১৩ সালে নতুন করে ১৪টি জীবন ও ২টি অ-জীবনসহ মোট ১৬টি বীমা কোম্পানির লাইসেন্স দেয় সরকার। বেসরকারি খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে জীবন ৫ হাজার ৪৩৮টি এবং অ-জীবন বীমার ১ হাজার ২১১টি শাখা কার্যালয় সারা দেশে ছড়িয়ে আছে।

জানা গেছে, কঠোর নজরদারির অভাবে থামছে না বীমা কোম্পানিগুলোর অনিয়ম। নিয়ম-বহির্ভূতভাবে এজেন্ট নিয়োগ থেকে শুরু করে ভুয়া এজেন্টের মাধ্যমে লাখ টাকার কমিশন উত্তোলনেও পিছ-পা হচ্ছে না কোম্পানিগুলো। ফলে মেয়াদ শেষে গ্রাহক পাচ্ছে না টাকা। প্রিমিয়াম আয়ে পড়েছে ভাটা। এই চিত্র দেশের অধিকাংশ বীমা কোম্পানির। ফলে গ্রাহকের আস্থাও কমছে। এ প্রসঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ চেয়ারম্যান এম. শেফাক আহমেদের বক্তব্য জানতে, তার মুঠোফোনে একাধিক কল এবং খুদে বার্তা প্রেরণ করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে বীমা কোম্পানি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশন (বিআইএ) সভাপতি শেখ কবির হোসেন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বীমা খাতে বহু বিশৃঙ্খলা আছে। জটিলতাও অনেক। সবকিছুই জটিলতার মধ্যে চলছে, সেগুলোরই সমাধান আমরা চাই। এ জন্য সম্প্রতি অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে সমাধান চেয়েছি। তখন আমরা বীমা খাতে যে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করেছি, তা পুনর্ভরণের একটা সিস্টেম করতে চেয়েছেন মন্ত্রী। মানে অতিরিক্ত খরচের টাকা ফেরত দেওয়া। তথ্যপ্রযুক্তির ইন্টিগ্রেটেড সফটওয়্যার ব্যবহার সরকার নিশ্চিত করলে, বীমা খাতে বিরাজমান বিশৃঙ্খলা দূর করা সম্ভব হবে। দেশের বীমা খাতের চলমান সংকট উত্তরণে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মুহিতকে দেওয়া বিআইএর‘সুপারিশ ও প্রস্তাবনা’ শীর্ষক পত্রে বলা হয়, বর্তমান সরকার তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করছে। বীমা শিল্পে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ইন্টিগ্রেটেড সফটওয়্যার ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে এই খাতের বিশৃঙ্খলা দূর করা সম্ভব হবে। বীমা খাতের জন্য ১৯টি বিধি ও প্রবিধি প্রণীত হলেও, এ খাতের সার্বিক উন্নয়নে আরও কিছু বিধি ও প্রবিধি প্রণয়ন বিশেষভাবে প্রয়োজন। বীমা আইনের কিছু ধারা পরিবর্তন ও নতুন ধারার সংযোজন এবং দ্রুত বাস্তবায়ন জনস্বার্থে অতি জরুরি। এ খাতের ব্যবসার প্রসারের জন্য বীমা এজেন্ট নিয়োগ ও বীমা ব্রোকারদের লাইসেন্স প্রদানের জন্য প্রবিধি দ্রুত প্রণয়ন করা প্রয়োজন। বীমা আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ব্যাংক কোম্পানি আইন ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কিছু প্রজ্ঞাপন। যেমন— বীমা আইন অনুযায়ী বীমা কোম্পানির পরিচালক কোনো ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না। কিন্তু ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী ব্যাংকের পরিচালক বীমা কোম্পানির পরিচালক হতে পারবেন। আবার পরিচালনা বোর্ডে স্বতন্ত্র পরিচালকের সংখ্যা কেমন হবে, তা বীমা আইন ও বিএসইসির প্রজ্ঞাপনে ভিন্নরূপ নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। ওই পত্রে আরও বলা হয়, সলভেন্সি মার্জিন (খরচের সক্ষমতা সীমা) সম্পর্কিত বিধি প্রণয়ন করে জীবন ও অ-জীবন বীমা কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা খরচের বিরাজমান জটিলতা দূর করা সম্ভব হবে। সম্প্রতি অ-জীবন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা খরচের যে সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা বর্তমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই জীবন ও অ-জীবন বীমা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা খরচের সীমা বাড়ানো একান্ত প্রয়োজন। একই সঙ্গে সম্প্রতি সরকার অতীত বছরগুলোতে বীমা কোম্পানি সমূহের ব্যবস্থাপনার জন্য খরচের অতিরিক্ত অর্থ পরবর্তী বছরগুলোতে পুনর্ভরণের যে নির্দেশ জারি করা হয়েছে, তা বাস্তব ও আইন সম্মত নয়। বিআইএ বলেছে, বীমা কোম্পানির লাইসেন্স নবায়নের ক্ষেত্রে ভ্যাট প্রদানের বিষয়টি উল্লেখ না থাকায় তা প্রদান করা হয়নি। কিন্তু বীমা কোম্পানিগুলোর কাছে বিগত ৫ বছরের ভ্যাট চাওয়া হয়েছে, তা রহিত করা হোক। আবার এজেন্ট কমিশনকে ভ্যাট আইনের অন্যান্য সেবার আওতাভুক্ত করে ১৫ শতাংশ হারে অর্থ আদায়, অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু পারিশ্রমিকের ওপর ভ্যাট হয় না। সম্প্রতি কয়েকটি বীমা কোম্পানির এজেন্টদের কমিশন বা পারিশ্রমিকের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাটের বিষয়ে রিট করেছে। এ বিষয়টির আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে একটি সমঝোতা হওয়া প্রয়োজন। ক্ষুদ্র বীমা গ্রাহকদের সামাজিক সেবা থেকে বঞ্চিত না করতে ৫ শতাংশ গেইন ট্যাক্স থেকে অব্যাহতি দেওয়া হোক। আইন সিদ্ধ না হলেও এনজিওরা নিজেরাই বীমা করছে। এসব এনজিও সমূহের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক। জানা গেছে, দেশের বীমা খাতে অলস টাকার পরিমাণ প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। বিনিয়োগ উপযোগী এই অর্থ কোম্পানিগুলো চাইলেই বিনিয়োগের মাধ্যমে পলিসি হোল্ডারদের মধ্যে মুনাফা বণ্টন করতে পারে। দীর্ঘ সময় পড়ে থাকা এই অর্থ বিনিয়োগ না হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন গ্রাহকরা। পুঁজিবাজারে ২০১০ সালে ধসের সময় আলোচনায় এসেছিল বীমা খাতের অলস পড়ে থাকা প্রায় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের। কিন্তু নানা করণে এবং নীতিমালার অভাবে এই টাকা বিনিয়োগ হয়নি। বীমা সংশ্লিষ্টদের মতে, বীমা খাতের অলস যে পরিমাণ টাকা পড়ে আছে, তা বিনিয়োগ উপযোগী। কোম্পানিগুলো চাইলেই উপযুক্ত খাতে বিনিয়োগ করতে পারে। বিনিয়োগের মাধ্যমে কোম্পানিগুলোর যে মুনাফা আসতো তার একটি অংশ পলিসি হোল্ডারদের হিসাবে যুক্ত হতো। কিন্তু অলস পড়ে থাকায় মূলত গ্রাহকরাই মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সর্বশেষ ২০১৩ সালের শেষে অনিরীক্ষিত হিসাবে বীমা খাতের মোট সম্পদ ৩৩ হাজার ৫৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। মোট জীবন ও অ-জীবন তহবিল ২৩ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। এর মধ্যে অ-জীবন তহবিল ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। জীবন বীমা খাতে মোট সম্পদ ছিল ২০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা। তার ওপর ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে ২০১৩ সাল শেষে জীবন তহবিল হয় ২৩ হাজার কোটি টাকা। আইন অনুযায়ী ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতি বছর সরকারি ট্রেজারি বন্ডে ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ করতে হয়। সে হিসাবে ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ রয়েছে ৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। বাকি তহবিল থেকে আরও ২০ শতাংশসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগসহ মোট ৫০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। ফলে এখনো বীমা খাতে বিনিয়োগযোগ্য তহবিল রয়েছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর