সোমবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

নিবন্ধন সত্ত্বেও যন্ত্রণার ঘোরপ্যাঁচে বহু শিক্ষক

আকতারুজ্জামান

বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করতে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছে শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। নীতিমালা অনুযায়ী ১৪ হাজার ৬৬৯ শূন্য পদের জন্য আবেদন করেন দুই লাখ ৪৯ হাজার ৫০২ চাকরিপ্রত্যাশী। গত ৯ অক্টোবর আবেদনের প্রথম মেধা তালিকা প্রকাশ করে এনটিআরসিএ। এরপর থেকে আসতে শুরু করেছে নানা অভিযোগ। অভিযোগ উঠেছে, ফল প্রকাশের ক্ষেত্রে এনটিআরসিএ কর্তৃপক্ষ কোনো নিয়মেরই ধার ধারেনি। এসব অনিয়মে চাকরি না পেয়ে বিপাকে পড়েছেন নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ লক্ষাধিক প্রার্থী।

প্রার্থীরা বলছেন, প্রায় অর্ধশতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আবেদন করেও কোনো স্কুল-কলেজে নিয়োগ না পেয়ে নানা অনিয়ম আর অভিযোগ তুলে ধরে প্রার্থীরা এনটিআরসিএ কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেছেন দফায় দফায়। এরপর দ্বিতীয় মেধা তালিকার ফল প্রকাশ করা হয় ১৩ নভেম্বর। তৃতীয় ধাপের মেধা তালিকা প্রকাশ করা হয় ৭ ডিসেম্বর। কিন্তু ভুক্তভোগীদের অভিযোগ কমেনি। বরং বেড়েছে। দফায় দফায় এ ফলাফলের বিরুদ্ধে রিট করেছেন বিক্ষুব্ধ চাকরিপ্রার্থীরা। তাদের অভিযোগ, অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শূন্যপদ থাকলেও কর্তৃপক্ষ সেই শূন্যপদে তালিকা দিতে স্কুল-কলেজ কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করেনি। তাই বিপুল পরিমাণ নিবন্ধিত যোগ্য প্রার্থী চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন নিবন্ধন পাওয়া বেসরকারি চাকরিপ্রার্থীরা। যশোরে সংবাদ সম্মেলন করে চাকরিপ্রার্থীরা বলেছেন, তাদের চাকরির বয়স পার হয়ে যাচ্ছে। অনেক নারী প্রার্থীর বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তারা নিয়োগ পাচ্ছেন না। তারা বলেন, নিয়োগ না পেলে আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় থাকবে না। জানা গেছে, মোছা: নাজমুন নাহার সেতু (রোল নং-৪২৩১৯২০৯, ব্যাচ-১২) প্রথম মেধা তালিকায় কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি থানার কাশিপুর ডিগ্রি কলেজ ও ফুলবাড়ি মহিলা ডিগ্রি কলেজে নিয়োগের জন্য মনোনীত হন। ফুলবাড়ি মহিলা ডিগ্রি কলেজে যোগদান করেন তিনি। দ্বিতীয় মেধা তালিকায় তিনি ফুলবাড়ি মহিলা ডিগ্রি কলেজসহ রংপুর জেলার কুতুবপুর বিএল হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজে নিয়োগের জন্য মনোনীত হয়েছেন। মনোয়ারা বেগম (রোল নং-৪২৩০৩৬০৭, ব্যাচ-১২) প্রথম মেধা তালিকায় কুড়িগামে নাগেশ্বরী উপজেলার কোচাকাটা ডিগ্রি কলেজে নিয়োগের জন্য মনোনীত হন এবং যোগদান করেন। কিন্তু দ্বিতীয় মেধা তালিকায় কোচাকাটা ডিগ্রি কলেজসহ আরও একটি কলেজ ফুলবাড়ি উপজেলার কাশিপুর ডিগ্রি কলেজে নিয়োগের জন্য পুনরায় মনোনীত করা হয়। প্রকাশিত তৃতীয় মেধা তালিকা প্রকাশ করা হলেও সেখানে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। এভাবেই একটি প্রতিষ্ঠানে তারা যোগদান করলেও পরের মেধা তালিকাতেও তাদের নিয়োগের জন্য মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এতে বঞ্চিত হচ্ছেন অনেক চাকরিপ্রার্থী। চাকরির জন্য হন্যে হয়ে থাকা বেকার তরুণ-তরুণীরা বেকারই থাকছেন। একইভাবে কুতুবপুর বিএল কলেজে নিয়োগের জন্য মনোনয়ন পেয়ে প্রথম মেধা তালিকার পর যোগদান করেন শাহ সৌদা ইসলাম (রোল নং- ৪২৩১৯২০৯, ব্যাচ- ১০)। তিনি রংপুরের পীরগাছা উপজেলার রমজান আলী মুন্সি কলেজেও মনোনীত হয়েছিলেন। ১৩ নভেম্বর প্রকাশিত দ্বিতীয় মেধা তালিকাতেও তিনি রমজান আলী মুন্সি কলেজে সিলেক্টেড হন। তৃতীয় মেরিট লিস্ট প্রকাশ করা হলেই সে ফলাফলেও তিনি রমজান আলী মুন্সি কলেজেই সিলেক্টেড রয়েছেন। অপরদিকে নিয়োগের জন্য একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মনোনীত হওয়ার পর একটি স্কুলে যোগদান করলেও পরের প্রকাশিত মেধা তালিকায় যোগদান না করা স্কুলে কোনো প্রার্থীকে নিয়োগের জন্য মনোনীত করা হয়নি এমন অভিযোগও কম নয়। রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার শুকুরেরহাট ডিগ্রি কলেজে প্রথম মেধা তালিকাভুক্ত হয়ে যোগদান না করলেও দ্বিতীয় মেধা তালিকায় কোনো প্রার্থীকে সেখানে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়নি। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার বারইয়ারহাট কলেজে গণিত বিষয়ে প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য আবেদন করেছিলেন বিবি আসমা। শিক্ষা জীবনে সব পাবলিক পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছেন তিনি। বিবি আসমার অভিযোগ, গণিতসহ ৪টি বিষয়ে প্রভাষক পদে নারী কোটা হিসেবে এনটিআরসিএতে চাহিদা পাঠায় কলেজ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এনটিআরসিএ একজন নারীকেও নির্বাচিত করেনি। মন্ত্রীর নির্দেশনা নিয়ে এনটিআরসিএ চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করলেও তিনি কোনো সমাধান পাননি। আসমার অভিযোগ, নারী পাওয়া না গেলে পুরুষ নিয়োগ দেওয়া হবে। কিন্তু মহিলা প্রার্থী থাকলেও তারা উপেক্ষিত কেন থাকবেন। এদিকে জাতীয়করণের প্রক্রিয়াধীন থাকা স্কুল-কলেজে শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা না থাকায় বিপাকে পড়েছেন এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগের জন্য মনোনীতরা। তাদের নিয়োগ করতে দেওয়া হচ্ছে না প্রতিষ্ঠানগুলোতে। নিরুপায় হয়ে মনোনীতরা শিক্ষামন্ত্রী, সচিব ও এনটিআরসিএ চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। সম্প্রতি যশোরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা নানা অভিযোগ তুলে ধরেন। ’৯৪ সালে এসএসসি উত্তীর্ণ রুমা পারভীন নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ২০০৫ সালে। গত ১১ বছরে প্রায় দশটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য ধর্ণা দিয়েও বিফল হয়েছেন। তিনি বলেন, বহু বছর ধরে সংগ্রাম করে আসছি, ধৈর্য ধরে আছি। আমার চেয়েও কম নম্বর পেয়েও অনেকের চাকরি হয়েছে। আমার পরে নিবন্ধন পাস করেও তাদের চাকরি হয়েছে। কিন্তু টাকা দিতে না পারায় আমি কোথাও চাকরি পাইনি। যশোর শহরের চারখাম্বা মোড় এলাকার সেলিনা খাতুন প্রথম নিবন্ধনে পাস করেন। ১১তম স্কুল নিবন্ধনে পাস করেন জেলার লক্ষ্মী রানী সরকার। তিনি ১২তম কলেজ নিবন্ধনেও যশোর সদর থেকে তৃতীয় স্থান দখল করেন। ১১তম কলেজ নিবন্ধনে পাস করেন ওসমান গণি। আর ২০০৯ সালে স্কুল নিবন্ধনে পাস করেন শিল্পী রানী সিংহ। সবারই বয়স বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমানে কেন্দ্রীয়ভাবে এনটিআরসিএর মাধ্যমে নিয়োগ পদ্ধতিতে একাধিক আবেদন করেও চাকরির জন্য মনোনীত হননি তারা। সংবাদে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আমাদের যশোর প্রতিনিধি সাইফুল ইসলাম সজল।

সর্বশেষ খবর