সোমবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
প্রকৃতি

পানকৌরির বাস শিশুল গাছে

সরকার হায়দার, পঞ্চগড়

পানকৌরির বাস শিশুল গাছে

উঁচু পাড় টলটলে জলের দিঘি দলুয়া। সবমিলিয়ে আয়তন ২০  একরের মতো। নিভৃত পল্লীর নামের সঙ্গেই জুড়ে গেছে দিঘির নাম। গ্রামের নাম দলুয়া। দিঘির নাম দলুয়ার দিঘি। ঠিক কবে এই দিঘি খোঁড়া হয়েছিল স্থানীয়রা কেউ জানে না। তবে কিছু অংশ অবৈধ দখল করে গড়ে উঠেছে বসতবাড়ি, আর একটি পাড়ে গোরস্তান। অন্য একটি পাড়ে কবে একটি শিমুল গাছ আস্তে আস্তে বড় হচ্ছিল সেই ইতিহাসও কেউ বলতে পারে না। অজান্তেই শিমুলগাছটি এখন গোটা গ্রামের নির্দেশিত প্রতীক। কাঁচা রাস্তা পেরিয়ে দলুয়ায় প্রবেশ করার কয়েক কিলোমিটার আগেই চোখে পড়বে প্রায় অর্ধশত বছরের পুরনো শিমুল গাছটি। গাছটি দখল করে নিরাপদ আবাস গড়েছে পানকৌড়ির দল। শীতের রোদমাখা এক ঝলমলে বিকালে সেই গ্রামে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই পাখির কিচির-মিচির কানে এলো। সেই সঙ্গে ঘাড়ে ঝোলানো ক্যামেরা দেখে হৈ-হৈ রৈ-রৈ করে ছুটে এলো একদল শিশু। ঘিরে ধরল তারা। অনেকে লুকিয়ে ক্যামেরাও ছুঁয়ে দেখল। খাতির জমিয়ে কৌশলে তাদের জিজ্ঞেস করলাম, কে কে পানকৌড়ির মাংস খেয়েছ? হাত তোল। একটি হাতও উপরে উঠল না। আবার প্রশ্ন করলাম এখানে এত পানকৌড়ি আর তোমরা কেউই পানকৌড়ির মাংস খাওনি! সবাই বলার চেষ্টা করল এই পাখিদের কেউ মারে না। আরও নানা বিষয়ে তাদের সঙ্গে কথাবার্তার মধ্যেই জড়ো হন গ্রামের অনেক নারী-পুরুষ। পাখিদের নিয়ে কথাবার্তায় বেশ মজা পাচ্ছিলেন তারাও। পুকুরের পাড়গুলো দখল করে অবৈধ বসতবাড়ি গড়ে ওঠার কাহিনী না বললেও তারা জানালেন, ‘বুঝ হওয়ার পর থেকেই তারা এই শিমুলগাছে পানকৌড়িদের আবাস দেখে আসছেন।’ তারা এও জানালেন, দলুয়ার এই শিমুলগাছসহ দিঘির আশপাশের বাঁশঝাড়ে শুধু পানকৌড়ি নয়—দেশীয় নানান পাখির নিরাপদ আবাস গড়ে উঠেছে। পাখিদের কলতানে মুখরিত থাকে গোটা গ্রাম। শিশু থেকে বয়স্কদের সবার সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, পাখিদের সঙ্গে তাদের যে সখ্য গড়ে উঠেছে—সেটা অনেক পুরনো। দিঘির কাছেই বাঁশঝাড় ঘেরা বাড়ি আলেমা বেগমের। বয়স ৩৫ কি ৪০। তিনি বললেন, ‘গ্রামের কেউ পাখি শিকার করে না। কিন্তু মাঝে মাঝে শহর থিকা লোকজন আসে। বন্দুক নিয়া আসে। তারা বস্তাভর্তি পাখি নিয়া যায়। মোটরসাইকেল নিয়া আসে। আমরা কিছু কইতে পারি না। আবার সইতেও পারি না। কিছু কইলে ভয় দেখায়।’ একই কথা জানাল মাদ্রাসাপড়ুয়া কিশোর ইউনুস আলীসহ আরও অনেকে। ঠিক কোন সময় পাখিরা থাকে—এমন প্রশ্নে শিশুরাই বলা শুরু করে দিল, ‘সকালে ওরা সবাই চলে যায় খাবার খাইতে। বিকেল থেকে আবার ফেরা শুরু করে।’ এ কথা শুনে আকাশের দিকে চোখ ফেলতেই দেখা গেল ঝাঁকবেঁধে পানকৌড়িরা ফিরছে। শিমুলগাছের ডালে ডালে তখন পানকৌড়িরা বসে চিৎকার-চেঁচামেচি করছে। সঙ্গীদের সঙ্গে ভালোবাসা বিনিময় করছে। সন্তানদের মুখে তুলে দিচ্ছে আহার। গ্রামের ২৫ বছরের যুবক কুদরত আলী জিজ্ঞেস করলেন, ‘যারা পাখি মারতে আসে তাদের শাস্তি দেওয়া যায় কি না? তার এমন প্রশ্নের উত্তরে পাখি ও বন্যপ্রাণি শিকারবিষয়ক আইন ও মূল্যবোধ নিয়ে ছোটখাটো একটা আলোচনাই হয়ে গেল। উপস্থিত সবাই তখন বললেন, এবার কেউ পাখি শিকার করতে এলে প্রতিরোধ করবেন। বোদা উপজেলার কালিয়াগঞ্জ ইউনিয়নের দলুয়ার দিঘির পাড়ে তখন নেমে এসেছে সন্ধ্যা। পাখি আর প্রাণীর নিভৃত এই গ্রামের মানুষের উদাত্ত ভালোবাসার কথা শুনে বিদায় নিলাম। পর দিন দুপুরেই আলেমা বেগমের ফোন পাব—এটা ভাবিনি। তিনি উত্তেজিতভাবে বললেন, ‘স্যার দুইটা লোক বন্দুক দিয়া পাখি মারতাছে। আমরা বাধা দিতাছি মানতাছে না। আপনি এখনই পুলিশ পাঠান।’ পুলিশকে জানানোর আগেই আবার আলেমার ফোন। হাসতে হাসতে সে জানায়, ‘স্যার গ্রামের সবাই বাইর হয়া আসছে। লোক দুটা মোটরসাইকেল স্টার্ট দিয়া পলায়া গেছে। আমি একটা লোকের শার্টের কলার ছিঁড়া দিছি।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর