বুধবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

উপঢৌকন নিয়ে ওষুধ লিখছেন চিকিৎসকরা

মাহবুব মমতাজী

ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির কাছ থেকে উপঢৌকন নিয়ে তাদের ওষুধগুলো প্রেসক্রিপশনে লিখছেন বিভিন্ন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত চিকিৎসকরা। বিভিন্ন উপহার আর আর্থিক সুবিধা নিয়ে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন তারা। এভাবেই মানহীন ওষুধ সাধারণ রোগীদের দিতে দ্বিধাও করছেন না তারা। যার ফলে রোগীদের চিকিৎসা নিতে অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।

জনস্বাস্থ্যবিষয়ক আইন ও পর্যবেক্ষণের অভাবে এসব অনৈতিক চর্চা করছেন চিকিৎসকরা— এমন অভিযোগ স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনকারী ও বিশেষজ্ঞদের। ২০১৫ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারে নিজেদের পণ্য টিকিয়ে রাখতে এ ধরনের কাজ করছে ওষুধ কোম্পানিগুলো। এক্ষেত্রে তারা তাদের সীমা লঙ্ঘনও করছে। তবে ওষুধ পণ্যের গুণাগুণ দিয়ে বাজারে টিকে থাকাটাই হবে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির নৈতিকতা। বিভিন্ন ধরনের প্রলোভন ও আবেগীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে অনেকটা নিজেদের পছন্দসই ওষুধ চিকিৎসকরা দিয়ে থাকেন বলে ওই গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে। গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা জনপ্রিয় ফিজিশিয়ান ও চিকিৎসকদের দ্বারা নিজেদের পণ্যগুলোকে প্রতিষ্ঠা করতে এ ধরনের কৌশলের আশ্রয় নেন। এমনিভাবে তারা তাদের এবং কোম্পানির বিক্রির লক্ষ্য পূরণ করে আসছে। সোলায়মান নামের মিটফোর্ডের এক ওষুধ দোকানদার জানান, ওষুধ কোম্পানিগুলো কিছু কিছু দোকানে শুধু তাদের পণ্যগুলো রাখার উৎসাহ জোগাতে বিভিন্ন ধরনের উপহারসামগ্রী দিয়ে থাকে। অথচ এ ধরনের অসদুপায় ও ঘুষ বন্ধ করা গেলে বিশ্ব বাজারের তুলনায় ওষুধের দাম অন্তত ৭০ শতাংশ কমে যেত- এমনি মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে মাস শেষে নিজেদের একটি ওষুধ কোম্পানির পণ্য প্রেসক্রিপশনে লেখার জন্য চিকিৎসকদের টাকা দেওয়ার দুটি প্রমাণপত্র বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে আছে। আর এ কাজটি অফিসিয়ালভাবে বৈধ করেছে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক নভারটিজ কোম্পানির সেনডোজ ডিভিশন। এসব আর্থিক লেনদেন বৈধ হয়েছে সেনডোজ ডিভিশনের হেড শেখ নাহার মাহমুদ ও ম্যানেজার ফজলে রাব্বী খানের স্বাক্ষরে। কোম্পানিটির ‘একলাসটা ৫ এমটি’ ওষুধের বাজার মূল্য ৩০ হাজার টাকা। আর এ ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লিখতে রাজধানীর ধানমন্ডি, গুলশান, পান্থপথ ও কুমিল্লার একাধিক চিকিৎসককে নগদ আর্থিক সুবিধা দিয়ে থাকে কোম্পানিটি। এর জন্য প্রতিটি চিকিৎকসকের পৃথক কোড নম্বরও দিয়েছে তারা। প্রেসক্রিপশনের ১০ শতাংশ ডিসকাউন্ট স্কিমসহ মাসে সর্বোচ্চ ৪ লাখ টাকা করে দেওয়া হয় কোডধারী একেকজন চিকিৎসককে। সূত্র জানায়, এই কোম্পানিটি এদেশে এভাবেই ওষুধের বাজারে বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকার বাণিজ্য করে আসছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, এ সংস্কৃতি আগে বাংলাদেশে প্রচলন ছিল না। কিছু বহুজাতিক কোম্পানি এসে এটা চালু করেছে। চিকিৎসকদের গিফট বা টাকা দেওয়াটাকে ওষুধ কোম্পানিগুলো মার্কেট প্রমোশন হিসেবে উল্লেখ করে। যদি এ প্রচলন না থাকত তাহলে ওষুধের দাম আরও কম হতো। কারণ কোম্পানিগুলো এ টাকা তো ভোক্তাদের কাছ থেকে নিচ্ছে। এটি খুবই অনৈতিক। এটি জরুরি ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। একটি ওষুধের যেমন ক্রিয়া আছে, তেমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়ও আছে। ওষুধের পরিমাণ বেশি হলে রোগীর সমস্যা আরও বেড়ে যায়। চিকিৎসকরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অনুমাননির্ভর ওষুধ দিয়ে থাকেন। কোনো কোনো চিকিৎসক আছেন যারা যে কোম্পানির কাছ থেকে সুবিধা নেন শুধু তাদেরই ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লিখেন। যারা নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন করে তারাই মূলত সুবিধাগুলো দিয়ে থাকে। বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, ওষুধের ক্ষেত্রে কোম্পানির আর চিকিৎসকের মধ্যে যে লেনদেন হয় তা সম্পূর্ণ অনৈতিক। এসব বন্ধে যথাযথ আইন এবং তা প্রয়োগের দরকার আছে। আর কোম্পানিগুলো তাদের ওষুধ প্রচারণার জন্য কত টাকা খরচ করবে তারও সীমাবদ্ধতা রাখা উচিত। যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) রুহুল আমিন জানান, এটা সম্পূর্ণ অনৈতিক। কিন্তু আমাদের অধিদফতরের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ডাক্তার নন। আমরা শুধু ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ করে থাকি। বিশেষজ্ঞরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রদত্ত গাইডলাইনের ১৯ নম্বর ধারাটি তুলে ধরে জানান, সেখানে বলা হয়েছে- প্রতিটি ওষুধ কোম্পানির উচিত হবে তাদের কার্যক্রম, উৎপাদিত পণ্য ও নিয়োজিত মেডিকেল প্রতিনিধিদের বিষয়ে দায়িত্বশীল হওয়া। ওষুধ ব্যবস্থাপত্রের জন্য কিংবা ওষুধের দোকানে কোনো ধরনের উপহার বা উপঢৌকন দেওয়া উচিত নয়। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, চিকিৎসকরা বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে তাদের উৎপাদিত ওষুধগুলো প্রেসক্রিপশনে  লেখেন সেটা অনেক ক্ষেত্রে সত্য নয়। যেহেতু বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে, তাই তদারকি করে যথাযথ ব্যবস্থা নেব।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর