সোমবার, ২ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

চাহিদা বাড়ছে হেলিকপ্টারের

বরযাত্রী-ভিআইপিদের কাছে কদর বেশি ব্যবসায় ৯ কোম্পানি

জিন্নাতুন নূর

চাহিদা বাড়ছে হেলিকপ্টারের

তরুণ ব্যবসায়ী আরিয়ান আহমেদ তার নববধূ তানিয়া আহমেদের ২৫তম জন্মদিনে চমকে দেওয়ার জন্য একটু ভিন্ন আয়োজন করলেন। জন্মদিনের সকালে স্ত্রীকে নিয়ে তিনি শাহজালাল বিমানবন্দরে চলে গেলেন। সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষায় ছিল একটি হেলিকপ্টার; যার সামনে লেখা ‘হ্যাপি বার্থডে তানিয়া’। এর পরের ১০ মিনিট যেন ঘোরেই কেটে গেল তানিয়া-আরিয়ান দম্পতির। হেলিকপ্টার তাদের নামিয়ে দিল বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে। আর ১০ মিনিটের এই হেলিকপ্টারের আনন্দ ভ্রমণের জন্য তাদের খরচ হলো মাত্র ১০ হাজার টাকা।

একসময় শুধু উচ্চবিত্তরা দ্রুত গন্তব্যে যেতে হেলিকপ্টার ব্যবহার করতেন। কিন্তু এখন প্রয়োজন ছাড়াও আনন্দ ভ্রমণের জন্য অনেকে এ বাহনটি ব্যবহার করছেন। ফলে মধ্যবিত্তের হেলিকপ্টারে আকাশে বেড়ানোর স্বপ্ন এখন বাস্তব ঘটনা। সাধারণত ঘণ্টাব্যাপী রিজার্ভ হেলিকপ্টারের ভাড়া ১ লাখের কম নয়। কিন্তু প্রিয়জনকে নিয়ে কেউ চাইলে ঢাকার কাছাকাছি থেকে আধ ঘণ্টার মধ্যে কোথাও ঘুরে আসতে মাত্র ১০ হাজার টাকায়ই এ স্বপ্ন পূরণ করতে পারবেন। হেলিকপ্টার ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা জানান, যানজটের ঝামেলা এড়াতে এবং দ্রুত ঢাকার বাইরে মিটিংয়ে যেতে অনেক ব্যবসায়ী এখন হেলিকপ্টার ব্যবহার করেন। এ ছাড়া রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কিংবা সেলিব্রেটিরাও ঢাকার বাইরে যেতে বেছে নেন হেলিকপ্টার। শুটিংয়ের কাজে তারকারা প্রায়ই হেলিকপ্টারে কক্সবাজার, গাজীপুর যাতায়াত করছেন। এ ছাড়া গার্মেন্ট   ব্যবসায়ীরা ঢাকার বাইরে গাজীপুর ও চট্টগ্রামে বিদেশি ক্রেতাদের নিয়ে কারখানা ভ্রমণের জন্য হেলিকপ্টারের ওপর নির্ভর করেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ফ্লাই হেলিকপ্টার বিডির সিইও এম আর হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে যাত্রীরা আধ ঘণ্টার জন্য নির্দিষ্ট কিছু গন্তব্যে মাত্র ১০ হাজার টাকায় হেলিকপ্টারে ঘুরে বেড়াতে পারবেন। তিনি জানান, সপ্তাহে কখনো পরপর দু-তিন বার তারা ফ্লাই করেন। আবার অনেকে রিজার্ভে ঘোরেন। তিনি বলেন, মূলত তাদের মূল টার্গেট মধ্যবিত্ত শ্রেণির যাত্রী। হেলিকপ্টার ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা আরও জানান, সাধারণত বিয়েবাড়ির বরযাত্রী, ভিআইপি যাত্রী বহনে হেলিকপ্টারের রিজার্ভ বেশি হয়। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ানো, লিফলেট বিতরণ, রোগী বহন, শুটিং, বাণিজ্যিক কাজে ঢাকার বাইরে গমন, লাশ বহনসহ বিভিন্ন কাজে এখন হেলিকপ্টারের ব্যবহার হচ্ছে। তবে হেলিকপ্টারের ব্যবসা বৃদ্ধি পেলেও এর রক্ষণাবেক্ষণ বেশ ব্যয়বহুল। তারা জানান, শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে তাদের হেলিকপ্টার ওড়াতে হয়। শুধু এই বিমানবন্দর থেকে ওড়ানোর অনুমতি থাকায় তারা প্রায়ই ঝামেলায় পড়েন। এয়ারফোর্সের প্রশিক্ষণ থাকাকালে তারা হেলিকপ্টার ওড়াতে পারেন না। এ ছাড়া ভিআইপি এলে তাদের অপেক্ষা করতে হয়। এজন্য হেলিকপ্টারের জন্য আলাদা একটি হেলিপ্যাড দাবি করেন তারা। তারা জানান, সাধারণত প্রতিরক্ষাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা হেলিকপ্টারের পাইলট হিসেবে কাজ করেন। আর জ্বালানি তেল, রক্ষণাবেক্ষণ, পাইলটসহ একটি হেলিকপ্টারের পেছনে মাসে ২০ থেকে ২২ লাখ টাকা খরচ হয়। বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) সূত্রে জানা যায়, দেশে হেলিকপ্টার ব্যবসার সঙ্গে বর্তমানে জড়িত ৯টি কোম্পানি। তাদের ১৮টি হেলিকপ্টার যাত্রী বহন করছে। এর মধ্যে আছে বাংলা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস লিমিটেড। তাদের বেল-৪০৭ মডেলের হেলিকপ্টারে প্রতি ঘণ্টার ভ্রমণমূল্য ১ লাখ টাকা আর রবিনসন আর-৪৪ মডেলের হেলিকপ্টারে প্রতি ঘণ্টার মূল্য ৬০ হাজার টাকা। স্কয়ার এয়ার লিমিটেডের বেল-৪০৭ হেলিকপ্টারে প্রতি ঘণ্টার ভ্রমণমূল্য ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা আর রবিনসন আর-৬৬-এর প্রতি ঘণ্টার ভ্রমণমূল্য ৭৫ হাজার টাকা। এর সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাট যোগ করতে হবে। সিকদার গ্রুপের বেল-৪০৭-এর ঘণ্টাপ্রতি ভ্রমণমূল্য ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা, রবিনসন আর-৪-এর ৭২ হাজার টাকা। এ ছাড়া হেলিকপ্টার ব্যবসার সঙ্গে আরও জড়িত আছে সাউথ এশিয়ান এয়ারলাইনস, ইমপ্রেস এভিয়েশন লিমিটেড, পারটেক্স এভিয়েশন, বিআরবি এয়ার লিমিটেড। প্রতিটি কোম্পানির নির্দিষ্ট ভ্রমণমূল্যের সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাট যুক্ত করতে হবে। ক্ষেত্রবিশেষ এ যানগুলোয় ৩ থেকে ৬টি করে সিট থাকে।

বেবিচকের একজন কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, ব্যবসা শুরুর আগে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ থেকে অনুমতি নিতে হবে। বেসরকারিভাবে হেলিকপ্টার পরিচালনার জন্য বেবিচকের কিছু নীতিমালা আছে। আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন সংস্থার আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সেগুলো তদারকি করে বেবিচক। হেলিকপ্টার কোম্পানিগুলোকে এগুলো মেনে চলতে হয়। অন্যথায় লাইসেন্স বাতিল ও স্থগিত করার ব্যবস্থা আছে। নিয়ম অনুযায়ী হেলিকপ্টার আকাশে ওড়ার কমপক্ষে ৬ ঘণ্টা আগে বেবিচকের অনুমতি নিতে হয়। তবে সংশ্লিষ্টরা বলেন, এই ব্যবসার মধ্যে নজরদারি আরও বৃদ্ধি করা উচিত। কারণ এগুলোর পর্যবেক্ষণে ফ্লাইট অপারেশন ইন্সপেক্টর আছেন মাত্র একজন। বিশেষ করে ১৬ অক্টোবর কক্সবাজারের উখিয়ায় মেঘনা এভিয়েশনের আর সিক্স সিক্স হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হওয়ার পর জানা যায় যে, হেলিকপ্টারটির সেই রুটে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। এ ছাড়া নজরদারির অভাবে বেশকিছু হেলিকপ্টার রাতে চালানোর অনুমতি না থাকা সত্ত্বেও আইন ভঙ্গ করছে। এতে এই ব্যবসায় নজরদারির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দেশে ১৯৯৯ সালে বেসরকারি উদ্যোগে প্রথম বাণিজ্যিক হেলিকপ্টার সেবা চালু করে সাউথ এশিয়ান এয়ারলাইনস। ২০০৮ সাল পর্যন্ত মাত্র ২টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ সেবা প্রদান করত। বর্তমানে লাইসেন্স পাওয়ার অপেক্ষায় আছে আরও বেশ কয়েকটি কোম্পানি।

সর্বশেষ খবর