বুধবার, ৪ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

অটোরিকশা ভাড়া নৈরাজ্য

হয়রানির শিকার সাধারণ যাত্রী

নিজামুল হক বিপুল

অটোরিকশা ভাড়া নৈরাজ্য

সরকার রাজধানীতে সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভাড়া নির্ধারণ করে দিলেও ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি কমছে না। বরং এখন অটোরিকশা-চালকরা মিটারের পরিবর্তে চুক্তিতেই ভাড়ায় যাচ্ছেন বেশি। আবার যেসব চালক মিটারে যাচ্ছেন, তারা মিটারের বাইরে যাত্রীদের কাছে অতিরিক্ত টাকা দাবি করছেন। ফলে প্রতিদিনই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় যাত্রীদের সঙ্গে অটোরিকশা-চালকদের বাদানুবাদের ঘটনা ঘটছে। সিএনজিচালিত অটোরিকশা মালিক ও চালকদের চাপাচাপিতে সরকার ২০১৫ সালের নভেম্বরে অটোরিকশার ভাড়া নতুন করে নির্ধারণ করে দেয়। এতে অটোরিকশার ভাড়া প্রায় ৬০ ভাগ বৃদ্ধি পায়। ভাড়া বৃদ্ধির পর কিছু দিন সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় সিএনজি অটোরিকশা চলাচল করলেও এখন মালিক ও চালকরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। তারা যাত্রীদের রীতিমতো জিম্মি করে মিটারের বদলে চুক্তিতে ভাড়ায় যাচ্ছেন এবং অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছেন। সরকার মিটার বাধ্যতামূলক করে দিলেও ৯০ ভাগ অটোরিকশাই মিটারে চলছে না। আর স্বল্প দূর কিংবা যাত্রীদের পছন্দের গন্তব্যে কোনো অটোরিকশাই যাচ্ছে না বা যেতে চায় না। অটোরিকশা-চালকরা গাড়ির জমার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, গ্যাসের দাম বৃদ্ধি, যানজটসহ নানা অজুহাত দেখিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছেন। বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, সরকার নির্ধারিত ভাড়া অনুযায়ী প্রথম ২ কিলোমিটারের ভাড়া ৪০ টাকা। আগে এর পরিমাণ ছিল ২৫ টাকা। প্রথম ২ কিলোমিটারের পর প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ১২ টাকা। আগে ছিল ৭ টাকা ৬৫ পয়সা। বিরতিকালের জন্য প্রতি মিনিটে আগের ১ টাকা ৪০ পয়সার স্থলে ২ টাকা নির্ধারণ করা হয়। একই সঙ্গে মালিকদের জমার পরিমাণ বাড়িয়ে ৬০০ থেকে ৯০০ টাকা করা হয়। ভাড়া বৃদ্ধির সময় যে কোনো দূরত্বে যাত্রী পরিবহনে বাধ্যতামূলক সর্বনিম্ন ভাড়া ৪০ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিটি অটোরিকশার জন্য সরকার নির্ধারিত জমা ৯০০ টাকার বদলে বেশির ভাগ মালিক এখন দিনে-রাতে ২৪ ঘণ্টায় দুই শিফটে গাড়ি ভাড়া দিয়ে জমা নিচ্ছেন ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত। এজন্য দিনের এক ভাগে একজন এবং অন্য ভাগে অন্য একজন চালককে গাড়ি ভাড়া দিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ একজন চালক দিয়ে দৈনিক ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা জমা নিচ্ছেন। এ ছাড়া সরকার কর্তৃক অটোরিকশার ভাড়া ও জমা নির্ধারণী ব্যয় বিশ্লেষণে মালিকের ৯০০ টাকা দৈনিক জমার মধ্যে ৪৮ টাকা গ্যারেজ ভাড়া সংযুক্ত থাকলেও গ্যারেজ মালিকরা প্রতিটি অটোরিকশা থেকে দৈনিক ৫০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত গ্যারেজ ভাড়া আদায় করছেন। ফলে এই টাকা ওঠাতে সিএনজিচালিত অটোরিকশা-চালকরা বেপরোয়া হয়ে মিটারের পরিবর্তে চুক্তিতে গাড়ি চালাচ্ছেন। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির সাম্প্রতিক এক পর্যবেক্ষণ থেকে জানা গেছে, নগরজুড়ে অটোরিকশার ৮৬ ভাগ চলছে চুক্তিতে। যারা মিটারে চলে তাদের ৯৭ ভাগ যাত্রীদের কাছ থেকে মিটারের বাইরে অতিরিক্ত আদায় করছে ২০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত। আর যাত্রীর পছন্দের গন্তব্যে যেতে রাজি হয় না ৮২ ভাগ অটোরিকশা। ওই পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, ঢাকা মহানগরীতে চলা প্রায় ১৪ হাজার বাণিজ্যিক অটোরিকশার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অটোরিকশার চাহিদা ও সংকট কাজে লাগিয়ে ঢাকা জেলার নিবন্ধিত ৪ হাজার ৫০টি প্রাইভেট অটোরিকশা যাত্রী পরিবহন করছে। যাদের সবাই চুক্তিতে যাত্রী পরিবহন করে। এ ছাড়া গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী থেকে নিবন্ধিত আরও প্রায় ৫ হাজার অবৈধ বাণিজ্যিক অটোরিকশা এবং ঢাকা জেলায় নিবন্ধিত বাণিজ্যিক নম্বরধারী প্রায় ৬ হাজার অবৈধ অটোরিকশা রাজধানীতে যাত্রী পরিবহন করছে। এসব অটোরিকশার সবই পারমিট ও নীতিমালার শর্ত লঙ্ঘন করে চুক্তিতে চলছে। এক হিসাব থেকে জানা গেছে, বর্তমানে ঢাকা মহানগরীতে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে প্রায় ২৯ হাজার অটোরিকশা চলছে। ঢাকা মহানগরীর অটোরিকশা সংকট নিরসনকল্পে সিএনজি অটোরিকশার সিলিং প্রথা বাতিল ও সার্ভিস নীতিমালা-২০০৭ বাস্তবায়ন প্রয়োজন। যাত্রীকল্যাণ সমিতি বলছে, সিএনজিচালিত অটোরিকশার এ নৈরাজ্য বন্ধে সরকারকে বেশকিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে— প্রতিটি অটোরিকশায় যাত্রীর আসনের সামনে ভাড়ার তালিকা; মালিক, চালক এবং বিআরটিএ ও পুলিশের ট্রাফিক অভিযোগ কেন্দ্রের নাম, ফোন নম্বরসহ নোটিস ঝোলানোর ব্যবস্থা করা; ঢাকা মহানগরীর বাইরের জেলায় নিবন্ধিত ও প্রাইভেট অটোরিকশা নগরীতে চলা বন্ধের ব্যবস্থা করা; সিএনজি অটোরিকশার ভাড়া, জমা ও ইকোনমিক লাইফ বৃদ্ধির আগে গণশুনানির উদ্যোগ গ্রহণ; যাত্রীস্বার্থ সুরক্ষায় মালিক-শ্রমিকের পাশাপাশি বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির প্রতিনিধি রাখা; অটোরিকশার নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি বন্ধে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার পাশাপাশি ট্রাফিক ইন্সপেক্টরদের নেতৃত্বে মনিটরিং ব্যবস্থা চালু এবং মিটার টেম্পারিং বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে মিটার চেকিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর