শুক্রবার, ৬ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার সবজি

সংরক্ষণের অভাব

রেজাউল করিম মানিক, লালমনিরহাট

রংপুর বিভাগের কৃষি অঞ্চলের জেলাগুলোতে সবজি সংরক্ষণে বিশেষায়িত কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে এ অঞ্চলে উদ্বৃত্ত সবজি টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর, মুলা ও শিমসহ দ্রুত পচনশীল সবজি সংরক্ষণেরও সুযোগ নেই। ভরা মৌসুমে দাম পড়ে গেলে কৃষকরা অনেক সময় খেত থেকে সবজি ওঠানো বন্ধ করে দেন। খেতে কোটি কোটি টাকার সবজি পচে নষ্ট হয়। দামে মার খাওয়ার পরের মৌসুমে কৃষকরা সেসব ফসল আবাদে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ফলে আবাদ কমিয়ে দিলে দাম বেড়ে যায়। সে সময় চড়া দামে এসব সবজি কিনতে হয়। দেশের অন্যতম প্রধান সবজি উৎপাদনকারী এলাকা হচ্ছে রংপুর বিভাগের লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়। এ ছাড়া রাজশাহী, নাটোর এবং পাবনায়ও প্রচুর সবজি উৎপাদন হয়। জানা গেছে, এবার রবি মৌসুমে রংপুরের আটটি জেলায় ৫৬ হাজার ৭২০ হেক্টর জমিতে সবজি জাতীয় ফসল চাষ করা হয়। সবচেয়ে বেশি সবজি আবাদ হয় দিনাজপুরে ১৩ হাজার ১০৫ হেক্টর জমিতে। এ ছাড়া লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে সবজি আবাদ হয় লালমনিরহাট ও নীলফামারী জেলায়। আট জেলা থেকে উৎপাদন হয় ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৫২০ টন সবজি। তবে এবার কৃষকরা মারাত্মক বিড়ম্বনায় পড়েন। নতুন মুলা বাজারে ওঠার পর প্রতি কেজি পাইকারি দাম ছিল ৩০-৪০ টাকা। এরপর দাম কমে ৪ টাকায় আসে। একই অবস্থা হয় টমেটো এবং কপির। ফলে ওইসব ফসল তুলে বাজারে বিক্রি করে লোকসান গুনতে হয়। খেতের আইলে মুলা ও টমেটো তুলে রাখতে দেখা যায়। এভাবে হাজার হাজার মণ ফসল নষ্ট করে ফেলা হয়।

লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার শিয়ালখাওয়া গ্রামের সবজি চাষি আতাহার আলী জনান, বাঁধাকপি ৭০০-৮০০ গ্রাম ওজনের প্রতি ১০০ পিসের পাইকারি দাম ছিল ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা। পরে বাঁধাকপির ক্রেতা ছিল না। ৪-৫ কেজি ওজনের প্রতিটি বাঁধাকপি বিক্রি হয় মাত্র ৮ টাকায়। বাঁধাকপি এখন গোখাদ্য। নতুন ওঠার পর এক কেজি ওজনের ফুলকপি পাইকারি ৩০-৩৫ টাকা পর্যন্ত দরে বিক্রি হয়। মৌসুমের শেষদিকে ২-৩ কেজি সাইজের প্রতিটির পাইকারি দাম ৩ টাকায় নেমে আসে। শেষদিকে এবার বাঁধাকপি-ফুলকপি পানির দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। ৪-৫ কেজি ওজনের প্রতিটি বাঁধাকপি মাত্র ২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। নতুন শিম পাইকারি প্রতি কেজি ৫০-৬০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। মৌসুমের শেষে শিম ৪ টাকা কেজি দরেও বিক্রি হয় না। সদর উপজেলার মহেন্দ্রনগর গ্রামের চাষি বাবলু মিয়া, সিরাজুল ইসলাম ও আতিকুল ইসলাম জানান, এবার মৌসুমে টমেটো বিক্রি করতে হয় মাত্র ২ টাকা কেজি দরে। একই কথা জানান, আদিতমারী উপজেলার কৃষক আবদুস সামাদ, মোসলেম উদ্দিন ও কামাল উদ্দিন। তারা টমেটো বিক্রি করতে না পেরে হাটেই সেগুলো ফেলে আসেন। ৪০-৫০ টাকা কেজির শিম বিক্রি হচ্ছে ৬ টাকা কেজি দরে।

এ অঞ্চলের কৃষকরা সবচেয়ে বেকায়দায় পড়েন এবার আলু নিয়ে। রংপুরের জেলাগুলোতে যে আলু ফলে, তার সিকিভাগেরও কম কোল্ড স্টোরেজে সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় না। এবার এ অঞ্চলে আলু ফলবে ২৫ লাখ ৫৯ হাজার ৬৭৫ টন। যে ৫০টি কোল্ড স্টোরেজ রয়েছে, এতে আলু সংরক্ষণ সম্ভব হবে মাত্র ৪ লাখ ৮ হাজার টনের মতো। বাকি আলু কোথায় রাখবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে কৃষকরা। শিম, কপি, মুলা, টমেটো ও শাক-সবজি সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই জেলাগুলোতে। এ জন্য বিশেষায়িত কোল্ড স্টোরেজ প্রয়োজন। কিন্তু তার কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে সবজি জাতীয় ফসল বেশি ফললেই ফেলে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন কৃষকরা। পরের বছর কৃষকরা যখন মার খাওয়া ফসলের আবাদ কমিয়ে দেন, সে সময় ওই ফসলের দাম বেড়ে যায়। তখন চড়া দামে কিনে খেতে হয়। এতে বিশেষ করে বর্গাচাষি এবং কৃষকরা বিভিন্নভাবে ফসলে মার খেয়ে আসছেন প্রায় বছর। এ ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর লালমনিরহাটের উপপরিচালক বিধু ভূষণ রায় জানান, সবজি জাতীয় ফসল সংরক্ষণের কোনো সুযোগ নেই এ অঞ্চলে। তিনি বলেন, সংরক্ষণের সুযোগ না থাকায় প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার সবজি পচে নষ্ট হয়। তার মতে, সবজি সংরক্ষণের সুযোগ থাকলে চাষিরা দাম পাবেন এবং ভোক্তাও সারা বছর কম দামে শীতের সবজি খেতে পারবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের রংপুর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক শাহ আলম সত্যতা স্বীকার করে জানান, রংপুরের বুড়িরহাট এলাকায় এনসিডিপি প্রকল্পের আওতায় একটি ৩ চেম্বার বিশিষ্ট ৩ টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি বিশেষায়িত কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু সরকারি নীতিমালা না থাকায় দুই বছর পূর্বে তা বন্ধ হয়ে যায়। তবে বিশেষায়িত কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর