শনিবার, ৭ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভয়ঙ্কর এক ফ্লাইওভার

শিমুল মাহমুদ

ভয়ঙ্কর এক ফ্লাইওভার

রাজধানীর উড়ালসড়কে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে তিন বছর আগে উদ্বোধন করা গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার যাত্রীদের জন্য বিপজ্জনক স্থাপনা হয়ে উঠেছে। গত দুই বছরে এই ফ্লাইওভারের বিভিন্ন পয়েন্টে অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে অন্তত ১০ জন মারা গেছেন। গতকালও ফ্লাইওভারের সায়েদাবাদ ও নিমতলী প্রান্তে দুটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। সকালে ফ্লাইওভারের সায়েদাবাদ প্রান্তে বাস থেকে নেমে অন্য পাশে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনার শিকার হন আফসানা আক্তার (২৫) নামে এক তরুণী। তাকে একটি মোটরসাইকেল ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। কাছাকাছি সময়ে নিমতলীতে নামার পথে আরেকটি দুর্ঘটনা ঘটে। একটি মাইক্রোবাস দুমড়ে-মুচড়ে দেয় একটি প্রাইভেট কারকে।

মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার ব্যবহারকারী চালক ও কয়েকজন যাত্রী জানান, এই ফ্লাইওভারের ওপর দুর্ঘটনা নতুন কিছু নয়। ফ্লাইওভারের যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ ও রাজধানী সুপার মার্কেটের প্রান্তগুলোতে বাস বা অন্য গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করা হয়। সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ীতে নিচের রাস্তা থেকে উপরে পথচারী ওঠানামার জন্য সিঁড়িও সংযুক্ত করা হয়েছে। ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে মানুষের চলাচলের কারণে চালক-পথচারী উভয়ই র্ঝুকিতে পড়েছেন। গত ১৫ নভেম্বর ফ্লাইওভারের ওপর বাস স্টপেজ স্থাপন নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিন একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, ফ্লাইওভারের ওপরে ৫টি স্থানে বাস স্টপেজ তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া যাত্রীদের ফ্লাইওভারে ওঠানামার জন্য তিনটি স্থানে সিঁড়ি তৈরি করা হয়েছে। ফ্লাইওভারে ওঠানামার র‌্যাম্পগুলোর সংযোগস্থলে অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে এই সিঁড়ি দিয়েই যাত্রীরা নিয়মিত ওঠানামা করছেন। বাস ছাড়াও হিউম্যান হলারে যাত্রীরা ওঠানামা করছেন ওই স্টপেজগুলোতে। রাস্তার দুই পাশেই এভাবে যাত্রী ওঠানামা করে। এতে গুলিস্তান বা পলাশীগামী যাত্রীরা একদিক দিয়ে বাসে উঠছেন, ফেরত আসা যাত্রীরা অন্যদিকে নামছেন। এরপর ঝুঁকি নিয়ে দৌড়ে ফ্লাইওভারের ওপর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যাচ্ছেন যাত্রীরা। এ জন্য ডিভাইডারের মাঝে সামান্য ফাঁকা জায়গাও রাখা হয়েছে। বাসের যাত্রীরা দিব্যি ঘুরছেন-ফিরছেন ফ্লাইওভারের ওপর। চঞ্চল পায়ে ছোট শিশুর বিপজ্জনক ছোটাছুটিও দেখা গেছে। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখা গেছে, পুরো ফ্লাইওভারটি অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। ফ্লাইওভারের বিভিন্ন স্থানে যাত্রীবাহী বাস ও হিউম্যান হলার থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করা হচ্ছে। বাস থেমে থাকার কারণে চলমান অন্য যানবাহনকে সতর্কতার সঙ্গে পেরোতে হচ্ছে। বাস থেকে নেমে পারাপারের সময় অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে। অন্যদিকে ফ্লাইওভারের বিভিন্ন স্থানে সড়কের সমান্তরালে কংক্রিটের সংযোগস্থলগুলো স্টিলের পাত দিয়ে মোড়ানো হয়েছে। ‘এক্সপানশন জয়েন্ট’ নামের এই অংশটির জোড়া কয়েক ইঞ্চি ফাঁকা। এই জোড়ায় বেশি ফাঁক থাকায় সেখানে মোটরসাইকেলসহ থ্রি হুইলারের চাকা আটকে দুর্ঘটনা ঘটে। এই ফ্লাইওভার দিয়ে গুলিস্তান থেকে শনির আখড়া ও পোস্তগোলা পর্যন্ত যাতায়াত করা যায়। এতে উঠতে ছয়টি এবং বের হতে সাতটি পথ রয়েছে। ফ্লাইওভারের ওপর এসব পথে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। সব মিলিয়ে মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার। বিশেষ করে মোটরসাইকেল আরোহীরা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন সবচেয়ে বেশি। গত ৩১ আগস্ট রাতে মোটরসাইকেলে ফ্লাইওভার পার হওয়ার সময় চাকা পিছলে গেলে পেছন থেকে আসা বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ যায় জহিরুল ইসলাম (৪০) ও আমজাদ হোসেন পাশার (৪২)। এর আগে ২০১৪ সালের ২৪ জুলাই একইভাবে মৃত্যু হয় মুজিবুর রহমান নামে আরেক মোটরসাইকেল আরোহীর। ৭ জুন নিহত হন দুই সহোদর নজরুল ইসলাম (৩৫) ও মেহেদী হাসান (২৮)। ২০১৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি শামীম রেজা নামে এক মোটরসাইকেল আরোহী একইভাবে মারা যান। দ্রুতবেগে ফ্লাইওভার অতিক্রমের সময় পিছলে পড়ে একই বছরের ২ নভেম্বর জ্যাকি হোসেন নামে এক স্কুলছাত্র নিহত হয়। যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনিসুর রহমান বলেন, হানিফ ফ্লাইওভারে মাঝে-মধ্যেই দুর্ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাও হচ্ছে। গাড়ির প্রচণ্ড গতি দুর্ঘটনার একটি কারণ।  স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) সাবেক প্রধান প্রকৌশলী শহীদুল হাসান বলেন, ফ্লাইওভারের ওপর যাত্রী ওঠানামা করানো নিরাপত্তার দিক থেকে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। এটি ফ্লাইওভারের বেসিক কনসেপ্টের বাইরে। এটি ফ্লাইওভারের ডিজাইনের সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তিনি বলেন, ফ্লাইওভার হলো যানজট এড়িয়ে দ্রুত পারাপারের জন্য। ব্যস্ত ইন্টারসেকশন ক্রস করার জন্য এটা করা হয়েছে। সেখানে বাস স্টপেজ করার কোনো সুযোগ নেই। ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) সাবেক অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক, পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এস এম সালেহ উদ্দিন বলেন, এরকম একটি রানিং ফ্লাইওভারের ওপর বাস স্টপেজ করা কোনোভাবেই উচিত নয়। দুই লেনের ফ্লাইওভারের ওপরে বাস স্টপেজ করা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি বলেন, যখনই একটি গাড়ি যাত্রী তোলার জন্য থেমে থাকবে তখন চলমান গাড়ির জন্য এটি বাধা সৃষ্টি করবে। দুর্ঘটনা ঘটবে। ফ্লাইওভারের ওপরও যানজটের সৃষ্টি হবে। এভাবেই দুর্ঘটনা ঘটছে। মূল কথা হচ্ছে, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের ওপরে বাস স্টপেজ করার বিষয়টি মূল নকশায় নেই। এটি করা হলো নকশার লঙ্ঘন। রাজধানীর প্রবেশমুখে যে উদ্দেশে ফ্লাইওভারটি তৈরি করা হয়েছে সেটাই ব্যাহত হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর