শনিবার, ৭ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

পথেই যাদের ঘর-সংসার

নগরীতে অর্ধলাখের বেশি ছিন্নমূল মানুষের দুঃসহ জীবন

জিন্নাতুন নূর

পথেই যাদের ঘর-সংসার

শীতের মধ্যেও ফুটপাথই ঠিকানা এদের। রাজধানীর পলাশী থেকে তোলা ছবি —জয়ীতা রায়

মেগাসিটি ঢাকায় জীবিকার তাগিদে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিনিয়ত ছুটে আসছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। খেয়েপরে বাঁচার আশায় ছুটে আসা এমন অনেক পরিবারকে এখন ঢাকার রাস্তায় থাকতে হয়। নগরীতে তাদের মাথা গোঁজার কোনো স্থান নেই। ঝড়-বৃষ্টি, শীত, রোদে এই পরিবারগুলোর শিশু থেকে বৃদ্ধ খোলা আকাশের নিচেই কাটিয়ে দিচ্ছেন দিনের পর দিন। পথেই তারা সংসার পাতেন আর পথেই তাদের ঘরবসতি। ছিন্নমূল এই মানুষের মধ্যে কিছু আছেন যাদের বস্তিতে ঘর ভাড়া দিয়ে থাকার সামর্থ্য নেই। আবার কেউ আছেন মাদকাসক্ত, কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্যহীন।

সম্প্রতি ঢাকার ছিন্নমূল মানুষ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখা যায়, ব্যস্ত সড়কের পাশের ফুটপাথে তারা পলিথিন, প্লাস্টিক বা শক্ত কাগজ দিয়ে ঝুপড়ি বানিয়ে থাকছেন। এই ঝুপড়ির পাশেই মাটির চুলায় রান্না করে খাচ্ছেন। আর পথের পাশেই করছেন মলমূত্র ত্যাগের কাজ। আবার কেউ থাকছেন নগরীর যাত্রী ছাউনিগুলোতে। সারা দিন কাজ করে সবজি বিক্রেতারা তরকারির ঝুপড়িতেই রাতে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়ছেন। আর ভ্যানচালক বা চা বিক্রেতারা তাদের ভ্যানেই রাত পার করে দিচ্ছেন। রাতে নগরীর কারওয়ানবাজার ও শাহবাগ এলাকায় এই দৃশ্য সব সময়ই দেখা যায়। কারওয়ানবাজারে এমনই এক ছিন্নমূল মানুষের সঙ্গে কথা হয়। পেশায় তিনি একজন ক্ষুদ্র সবজি ব্যবসায়ী। নাম মনির মিয়া। তিনি বলেন, ‘ঢাকায় দুই সপ্তাহ সবজি বেইচ্যা আবার গ্রামের বাড়ি যাই। টাকা কম দেইখ্যা বস্তিতে উঠি না। দিনে ঝুড়িতে সবজি বেচি। আর রাতে এর মধ্যেই গুটিসুটি মাইরা ঘুমাই পড়ি। নাইলে ঝুড়ি চুরি হইয়া যাইব।’ কারওয়ানবাজার ছাড়াও রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশন এলাকায় রাতে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ভাসমান মানুষ বস্তা বা প্লাস্টিক বিছিয়ে শুয়ে আছেন। এদের মধ্যে কিশোর ও তরুণদের সংখ্যাই বেশি। তাদের একজন জসিম এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘দিনে কাগজ টোকাই। আর রাতে এইখানে ঘুমাই। মা-বাবা নাই। পুলিশ মাঝে মাঝে আইস্যা উঠায় দেয়। চইল্যা গেলে আবার আইস্যা পড়ি।’ এই কিশোরদের অনেকেই এরই মধ্যে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। এ ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড ও সদরঘাটে, ফুটওভার ব্রিজ এবং রাস্তার আইল্যান্ডেও ছিন্নমূল মানুষকে ঘুমাতে দেখা যায়। নগরীর বাংলামোটর, মগবাজার চৌরাস্তা, হাইকোর্ট চত্বর এলাকা, গুলিস্তান, ফার্মগেট ও সোহরাওয়ার্দী এলাকার ফুটপাথ, মিরপুর শাহ আলী মাজার ও পীরেরবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় ছিন্নমূল মানুষকে থাকতে দেখা যায়। ভাসমান মানুষের সঙ্গে কাজ করে এমন সংগঠনগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্তরা জানান, কাজের আশায় দিন দিন ঢাকায় আসা ভাসমান ও ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই আশ্রয়হীনদের অনেকই আছেন যারা প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে ভিটেমাটি হারিয়ে ঢাকামুখী হচ্ছেন। ছিন্নমূল এই মানুষের মধ্যে যাদের কিছুটা অর্থ জমে তারা হয়তো একসময় ঢাকার কোনো বস্তিতে উঠছেন কিন্তু বস্তিতে থাকার সামর্থ্য যাদের নেই তারা সড়কের আইল্যান্ড, বাসস্ট্যান্ড ও রেলস্টেশনেই বসতি গড়ছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাব বলছে, ঢাকায় ভাসমান মানুষের সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন এই সংখ্যা আরও বেশি। তারা বলছেন, ভাসমান এই মানুষগুলোর থাকার জন্য যেমন কোনো স্থান নেই, তেমনি তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত। শহরের ছিন্নমূল মানুষ নিয়ে কাজ করে সাজিদা ফাউন্ডেশন। সংস্থাটির মতে, ঢাকায় অন্তত বিশ হাজারের মতো মানুষ রয়েছে যাদের ঘরবাড়ি বলে কিছু নেই। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বস্তি উন্নয়ন বিভাগের তথ্য, ছিন্নমূল মানুষের জন্য পাঁচটি পথবাসী কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরই মধ্যে ঢাকার ধলপুরে দুই কাঠা জমি বরাদ্দ নিয়ে তার নির্মাণকাজ শুরু করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে সেই কেন্দ্রে মতিঝিল, কমলাপুর, বাসাবো, যাত্রাবাড়ী এলাকার দুই হাজারের মতো ভাসমান মানুষকে সেবা দেওয়া হবে। এ ছাড়া রাজধানীর মানিকনগরে আরেকটি পাঁচতলা কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে যেখানে বর্তমানে ৩০০ ভাসমান মানুষ থাকছে। নাগরিক সুবিধার আওতায় আনার জন্য তাদের জন্ম নিবন্ধন সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্যও সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কাজ করা হচ্ছে। এতে তারা নাগরিক সুযোগ-সুবিধার আওতায় আসবেন। মূলত সিটি করপোরেশনের প্রতিটি জোনেই এ ধরনের কেন্দ্র নির্মাণের কথা ভাবা হচ্ছে। এর বাইরে বর্তমানে সারা দেশে প্রায় ১০ লাখ ভিক্ষুকের জন্য ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় মানুষের আশ্রয়ের জন্য ছয়টি আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে। যার আসন ক্ষমতা ১ হাজার ৯০০। যার প্রধানটি ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত। এ ছাড়া বাকিগুলো নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল, গাজীপুরের কাশিমপুর ও পুবাইল, ময়মনসিংহের ধলা ও মানিকগঞ্জের বেতি এলাকায়। বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে স্বল্প মেয়াদে দুই হাজার ভিক্ষুককে এসব আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু বিভিন্ন জটিলতায় এই কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত সংখ্যক মানুষ পুনর্বাসন করা সম্ভব হয়নি।  

ছিন্নমূলদের মধ্যে আছে মানসিক ভারসাম্যহীনও : রাজধানীর ছিন্নমূল মানুষ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখা যায়, এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানসিক ভারসাম্যহীন। এদের অনেকেই মানসিক অসুস্থতার জন্য পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অনেকেই দিনের পর দিন একটি নির্দিষ্ট স্থানে খোলা আকাশের নিচে দিন কাটান। অপরিষ্কার ও ছেঁড়া পোশাক, উশকো চুলধারী এই মানসিক রোগীরা পথের ধুলাবালিতেই দিন কাটান, এর মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েন। আশপাশের ময়লা-আবর্জনা থেকে ফেলে দেওয়া খাবার খুঁজে খান। মানবিকতার কারণে অনেকেই এদের ব্যবহূত কাপড় ও খাবার খেতে দেন। মিরপুর ১২ নম্বর এলাকা থেকে সেনানিবাস যাওয়ার পথে আইল্যান্ডেই একজন মধ্যবয়সী পুরুষ ও নারীকে এক মাস ধরে অবস্থান নিতে দেখা যাচ্ছে। দিনে-রাতে তাদের সেখানেই শুয়ে-বসে থাকতে দেখা যায়। শীতে কষ্ট পাওয়ায় আশপাশের মানুষ তাদের পুরনো কিছু কাপড় ব্যবহার করতে দিয়েছেন। এই প্রতিবেদক তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারা অন্যদিকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকেন কিন্তু কোনো কথা বলেনি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর