রবিবার, ৮ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

অগ্নি দুর্ঘটনা রোধে নাজুক অবস্থা

জিন্নাতুন নূর

অগ্নি দুর্ঘটনা রোধে নাজুক অবস্থা

রাজধানী ঢাকায় বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড মেনে আগুন নেভানোর জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে উল্লেখ আছে। কিন্তু অধিকাংশ ভবন মালিক এই নিয়ম মানছেন না। এমনকি ঢাকার বড় শপিং মল ও রেস্টুরেন্টগুলোর ভবন তৈরির সময় বিল্ডিং কোড মানা হচ্ছে না। আর আগুন লাগলে বরাবরের মতো নগরবাসী শুধু দমকল বাহিনীর ওপর নির্ভর করায় আগুনে জানমালের ক্ষতির পরিমাণও কমানো যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে এক ধরনের নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে। যা ভবিষ্যতের বড় দুর্ঘটনা সামাল দেওয়ার জন্য হুমকি। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগুনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে দমকল বাহিনীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরও নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। একইভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষকে আধুনিক যন্ত্রপাতির মজুদ ও প্রশিক্ষিত জনবলে স্বাবলম্বী হতে হবে। আর সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের সঙ্গে বেসরকারি পর্যায় থেকেও অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণে জোর দিতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ফায়ার সার্ভিসের একটি ফিলোসফি হচ্ছে আগুন লাগার প্রথম পাঁচ মিনিট হচ্ছে বিপজ্জনক সময়। ছোট একটি আগুনের ঘটনা যদি প্রথম পাঁচ মিনিটে নেভানো সম্ভব হয় তবে সেটি তেমন কোনো দুর্ঘটনা বলে বিবেচিত হয় না। আর এই পাঁচ মিনিটে স্থানীয়দেরই আগুন নেভানোর কাজটি করতে হবে। এ জন্য ফায়ার বিগ্রেডের ওপর নির্ভর করে থাকলে হবে না। স্থানীয়দেরই আগুন নেভানো বা কমাতে তৎপর হতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণের। কিন্তু এগুলো আমাদের এখানে নেই। এগুলোর ব্যবস্থা যদি আমরা নিশ্চিত করতে না পারি তবে আমাদের এখানে দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে। নিয়ম মেনে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তৈরি না করায় প্রায়ই নগরীর শপিং মলগুলোতে বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে। সর্বশেষ গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেটের অগ্নিকাণ্ডে ব্যবসায়ীদের বড় ধরনের ক্ষতি হয়। এ জন্য বেসরকারিভাবেও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা জোরদার করার বিষয়টি এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, শপিং মলের প্রতিটি দোকানে ফায়ার ফাইটিং বা অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা আছে কিনা তা যাচাই করেই দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইন্সেস দেওয়া উচিত। এখন মার্কেটের দোকানগুলো স্বঃতস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠেছে। যে যার খেয়ালখুশি মতো বৈদ্যুতিক তার লাগিয়েছে। রাসায়নিক দ্রব্য মজুদ করছে। অথচ আগুন নেভানোর জন্য এসব শপিং সেন্টারে স্বয়ংসম্পূর্ণ ‘ফায়ার ফাইটিং’ বা অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। কিন্তু শুধু ফায়ার ফাইটিংয়ের ব্যবস্থা থাকাই যথেষ্ট নয়। আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থাও করতে হবে। এই দুটো বিষয় নিশ্চিত করার পর যে বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো প্রতিনিয়ত এই বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। মাসে অন্তত একবার আগুন লাগলে করণীয় কী হবে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত। সমাধান হিসেবে এ জন্য সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের বাণিজ্যিক দোকানের ট্রেড লাইন্সেস প্রদানের আগে অগ্নিনির্বাপণে সেই ব্যবসায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছেন কিনা তা নিশ্চিত হয়েই লাইসেন্স দিতে হবে। নগর বিশেষজ্ঞ ও স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, আমাদের শপিং মলগুলোতে অগ্নি দুর্ঘটনা রোধের জন্য যথাযথ প্রতিরোধ ব্যবস্থা আছে কিনা তা সংশ্লিষ্টদের তদারকি করতে হবে। বড় শপিং সেন্টারগুলোতে হাইড্রেন্টের (আগুন নেভাতে ব্যবহূত পানির কল) ব্যবস্থা করতে হবে। আর সামগ্রিকভাবে ঢাকা শহরের জন্য ওয়াটার হাইড্রেন্টের সমন্বিত নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে। যাতে যে কোনো স্থান থেকে ফায়ার বিগ্রেড পানি নিতে পারে। সামগ্রিকভাবে সিটি করপোরেশন বা রাজউকের মাধ্যমে ঢাকার চারপাশের নদী থেকে পানি হাইড্রেন্টের মাধ্যমে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি বলেন, ঢাকার লোকসংখ্যা ও স্থাপনা যে অনুপাতে বাড়ছে সেভাবে ফায়ার স্টেশনের সংখ্যা বাড়ছে না। বিভিন্ন এলাকায় আগুন লাগলে তা দ্রুত সময়ে নেভানোর জন্য কাছে ফায়ার স্টেশন না থাকায় আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বাড়ছে। বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে নিয়মিত জনবল নিয়োগ দেওয়া হলেও এই বাহিনীতে জনবল স্বল্পতা বাহিনীটির জন্য একটি বড় দুর্বলতা। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এই সংস্থার জন্য নিয়মিত আধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয় না।

আধুনিক অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থায় জোর নিতে হবে : সারা দেশে এত বড় বড় দুর্ঘটনার পরও আমাদের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা এখনো বেশ অবহেলিত অবস্থায় রয়ে  গেছে। আর আগুন নেভাতে ব্লিডিং কোডে যে সব নির্দেশনা থাকে তা মেনে সবাই বহুতল ভবন তৈরি করেন না। খুব কম সংখ্যক ভবনেই আধুনিক অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা রাখা হয়। আমাদের বহুতল ভবনগুলোতে এই ব্যবস্থাগুলো বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু করা হচ্ছে না। এ কথা বলেছেন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর সহযোগী অধ্যাপক ড. তানভীর আহমেদ। তিনি বলেন, আমাদের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা যথাযথ নয়। আগুন নেভাতে আমাদের যে পরিমাণ পানি সংরক্ষণ করে রাখার কথা তা করা হয় না। আর আগুন নেভাতে ব্লিডিং কোডে যে সব নির্দেশনা থাকে তা মেনে সকলে বহুতল ভবন তৈরি করেন না। মানুষ মনে করে আগুন নেভাতে শুধু পানির সরবরাহ প্রয়োজন কিন্তু পানির পাশাপাশি আরও প্রয়োজন একটি ভবনের নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। আজকাল আগুন নেভানোর জন্য অনেক আধুনিক ব্যবস্থা আছে এগুলো ব্যবহার করা যায় কিনা তা দেখতে হবে।  আধুনিক যন্ত্রপাতির মধ্যে আছে স্মোক ডিকেক্টর, অটোমেটিক ফায়ার ডিকেক্টর ইত্যাদি। সাধারণত আধুনিক এই ব্যবস্থার ফলে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গেই পানি স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা নেভানোর কাজ শুরু করে। আমাদের বহুতল ভবনগুলোতে এই ব্যবস্থাগুলো বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু করা হচ্ছে না। কিন্তু শুধু আধুনিক এই ব্যবস্থা নয়, এর পাশাপাশি একটি ব্লিডিং-এর ধারণক্ষমতা অনুযায়ী সেখানে কি পরিমাণ অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র এবং তা কোথায়  রাখা, বিপদের সময় তা কীভাবে ব্যবহার করা উচিত এই বিষয়গুলো আমাদের ব্লিডিং কোডে দেওয়া আছে। ভবন মালিকরা এগুলো মেনে ভবন তৈরি করেন না।

ড. তানভীর বলেন, সাধারণভাবে একটি ভবনের নকশা তৈরির সময় সেখানে যে পরিমাণ পানি সংরক্ষণ করার কথা তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাখা হয় না। একটু অনুসন্ধান করলে হয়ত দেখা যাবে যে, রাজধানীর ভবনগুলোতে অগ্নিনির্বাপক  যে যন্ত্র আছে সেগুলোও মেয়াদ উত্তীর্ণ। এগুলো কাজ করে না। অর্থাৎ এ বিষয়ে নিয়মিত নজরদারির কথা থাকলেও তা হয়ত করা হয় না। একটি ভবনের তদারকির ক্ষেত্রে বেশ কতগুলো বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হয়। এরমধ্যে প্রতি বছরে ভবনের অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রগুলো ঠিক আছে কিনা তারও পরীক্ষা করতে হয়। ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ বা দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো সংস্থার মাধ্যমে এগুলোর নজরদারি করাতে হয়। প্রতিটি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের গায়ে এগুলো নিয়মিত তদারকি করা হয় কিনা সে ব্যাপারে সার্টিফিকেট থাকে। সেখানে শেষ কবে তা পরীক্ষা হয়েছিল তার তারিখ দেওয়া থাকে। এতে ফায়ার সার্ভিসের লোকদের স্বাক্ষর থাকার কথা। কিন্তু খোঁজ নিলে দেখা যাবে যে, এগুলো যখন কেনা হয়েছিল তার পর থেকে এগুলো আর পরীক্ষা করা হয়নি।

কেমিক্যাল ফায়ার নিয়ন্ত্রণে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন : রাসায়নিক পদার্থ থেকে সৃষ্ট আগুন নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কষ্টসাধ্য। আর ‘কেমিক্যাল ফায়ার’ নিয়ন্ত্রণে আমাদের ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ এখন দক্ষ নয়। এ জন্য কেমিক্যাল থেকে সৃষ্ট আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিস বাহিনীকে আরও প্রশিক্ষণ নিতে হবে। আর ভবন বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে আগুন লাগলে আমাদের আগে থেকেই তা প্রতিরোধ করার ব্যবস্থার ওপর জোর দিতে হবে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর অধ্যাপক ড. এ বি এম বদরুজ্জামান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব বলেন। ড. বদরুজ্জামান বলেন, সব ধরনের আগুন নিয়ন্ত্রণে আমাদের ফায়ার সার্ভিস বাহিনী এখনো স্বাবলম্বী হয়ে ওঠেনি। এ বিষয়ে বাহিনীকে প্রযুক্তিগতভাবে আরও স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে হবে। আমরা প্রায়ই দেখি যে, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় আগুন লাগলে সেখানকার রাস্তাগুলো অপ্রশস্ত হওয়ার কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না। রাসায়নিক পদার্থ থেকে সৃষ্ট আগুন নিয়ন্ত্রণে আলাদা ব্যবস্থা আছে। পানি দিয়ে এই আগুন নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব না। এ জন্য বিশেষ ধরনের ফোম ব্যবহার করা হয়। আর রাসায়নিক থেকে সৃষ্ট আগুন নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে ফায়ার সার্ভিস বাহিনীর আলাদাভাবে কোনো প্রশিক্ষণ আছে কিনা জানা নেই। এ ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে। আর যদি তা না থাকে তাহলে বাহিনীটির এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। তিনি বলেন, গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেটটি বেশ পুরনো। এই মার্কেটটি তৈরির সময় সংশ্লিষ্টরা অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার বিষয়টি চিন্তা করে তৈরি করেনি। এর ফলে এবার মার্কেটে আগুন লাগলে তা নেভানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। মার্কেটটির যে অংশে আগুন লেগেছিল সেখানে দাহ্য পদার্থের উপস্থিতি ছিল বেশি। সেখানে পুরনো ফার্নিচার, ফার্নিচারের স্প্রে, বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ, শীতাতপ যন্ত্র ও গ্যাস সিলিন্ডার ছিল।

 এগুলো আগুনের সংস্পর্শে এসে মার্কেটটির আগুন আরও উসকে দেয়। গুলশানের আগুনে মার্কেটটির এক অংশ ধসে পড়ে। আর দেয়াল চাপায় দোকানগুলোর ভিতরে থাকা বিভিন্ন দাহ্য পদার্থ আগুনের সংস্পর্শে এসে আবারও জ্বলে ওঠে। এ জন্য সেখানে দীর্ঘক্ষণ ধোঁয়া দেখতে পাওয়া যায়।

এই অধ্যাপক বলেন, নিয়ম মেনে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে রাসায়নিক পদার্থ সংরক্ষণ করতে হবে। যদি তা না করা যায় তবে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থেকে যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি হাটখোলায় আগুন লাগে তবে সেখানে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে। কেননা সেখানে প্রচুর পরিমাণ রাসায়নিক দ্রব্যের মজুদ আছে। আর আগুন লাগলে এসব দাহ্য পদার্থ সেই পরিস্থিতি আরও উসকে দেবে। বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ১০ তলার ওপর কোনো নতুন ভবন নির্মাণ করার ক্ষেত্রে সে ভবনে আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার পাম্পসহ আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকতে হবে। আর বাণিজ্যিক ভবনে বাধ্যতামূলকভাবে এই ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন নির্মিত ভবনগুলোর কিছু আগুন নেভানোর জন্য এখন বিল্ডিং কোড মানছে। এ জন্য বিল্ডিং কোডের নিয়ম মেনে আরবান প্ল্যান মেনে আবাসিক ও অনাবাসিক এলাকায় ভবন নির্মাণ করতে হবে। আগুন লাগলে সবসময় তা পানি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। পুরান ঢাকার নিমতলীতে আমরা সেটি দেখেছি। বাইরের দেশে আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবস্থা আছে। আমাদের দেশে এই ব্যবস্থা এখনো চালু হয়নি। এ ছাড়া আমাদের আগুন নেভানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও উপকরণেরও অভাব আছে।

সর্বশেষ খবর