সোমবার, ৯ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

মাদানী এভিনিউ দখল অভিশাপ

বিক্রি হচ্ছে সড়কের পজেশন, মাসে ৬০ লাখ টাকার চাঁদাবাজি, জে ব্লকও গিলে খাচ্ছে দখলবাজরা, চাঁদার ভাগ যায় পুলিশসহ অনেকের পকেটে

নিজস্ব প্রতিবেদক

মাদানী এভিনিউ দখল অভিশাপ

রাস্তা দখল করে অবৈধ স্থাপনা গড়ে ওঠায় দিনভর যানজট লেগেই থাকে নতুনবাজার ১০০ ফিট সড়কে —বাংলাদেশ প্রতিদিন

দখলবাজদের ভয়ঙ্কর অভিশাপে আটকে আছে ১০০ ফুট রোড খ্যাত মাদানী এভিনিউ। রাজউক, সিটি করপোরেশনের বারবার উদ্যোগ সত্ত্বেও কূটনৈতিক পল্লীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কটি কোনোভাবেই জবরদখলমুক্ত হচ্ছে না। এরই মধ্যে গোটা সড়কটি ভিড়-ভাড়াক্কার হাটবাজারে পরিণত হয়েছে। ব্যস্ততম সড়কের মধ্যেই গড়ে উঠেছে হকার্স মার্কেট, রেন্ট-এ-কার সেন্টার, পিকআপ-ট্রাকের মিনি টার্মিনাল, অটোস্ট্যান্ড, লেগুনা  স্ট্যান্ড, বাঁশ বাজার,  ফলপট্টিসহ রমরমা কাঁচাবাজার। সড়কের উভয় পাশে কয়েক সারিতে দোকানপাট গড়ে রাস্তার বেশির ভাগ জায়গা জবরদখল হয়ে গেছে। সড়কের মাঝের আইল্যান্ডও দখল করে বিভিন্ন সংগঠনের কার্যালয়, কফি হাউস, পীর-ফকিরের দরবার শরিফ বসেছে। ফাঁকা থাকা এক চিলতে রাস্তা দিয়ে যানবাহন ও পথচারী চলাচল করতে গিয়েই বাধছে ভয়াবহ যানজট। বেরাইদসহ পূর্বাচল ও রূপগঞ্জে সহজ যোগাযোগের জন্য নির্মিত ১০০ ফুট প্রশস্ত রাস্তাটি রাজধানীর বাইপাস রোড হিসেবে যানজট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কথা ছিল। কিন্তু অসংখ্য গাড়ি আর হাজার হাজার মানুষ চলাচলে ব্যস্ত রাস্তাটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়াই এখন কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাটারা থানার মোড় (নতুনবাজার) থেকে ১০০ ফুট রাস্তার দুই কিলোমিটার জুড়ে বসেছে হাটবাজার। সেখানে ৮-১০টি হকার্স মার্কেটসহ নির্মিত হয়েছে শত শত অবৈধ স্থাপনা। রাস্তার উভয় পাশে ফুটপাথের পুরোটাই গিলে খেয়েছে ক্ষমতাসীন দলের সাইনবোর্ড-সর্বস্ব কার্যালয়গুলো। শুধু সড়ক ও ফুটপাথ দখল করতেই নামের আগে-পিছে ‘লীগ’ আর ‘মুক্তিযোদ্ধা’ ব্যবহার করে বিভিন্ন ভুঁইফোড় সংগঠন খুলে বসেছে কেউ কেউ। এসব সংগঠনের নামে রাস্তার জায়গা রীতিমতো পজিশন আকারে কেনাবেচা পর্যন্ত চলছে। রাস্তার মধ্যবর্তী আইল্যান্ড জুড়ে ফলের দোকান, মাছের বাজার, হোটেল-রেস্তোরাঁ গজিয়ে উঠেছে। এসব স্থানে চার হাত বাই পাঁচ হাত জায়গায় দোকান বসাতেও পজিশন বাবদ এককালীন দিতে হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা। এখন প্রতিদিন ২০০ টাকা ভাড়ার পাশাপাশি চাঁদা দিতে হয় ৫০ টাকা। পাশেই ফলের বাজারে চাঁদাবাজি চলে ১০০ টাকা হারে। চাঁদাবাজদের কবল থেকে ভ্রাম্যমাণ হকাররা পর্যন্ত রেহাই পায় না। ডিম, মুড়ি-চানাচুর, পান-সিগারেট বিক্রেতাদের থেকেও  তোলা হচ্ছে ২০ টাকা হারে চাঁদা। হাতেগোনা কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা ও পুলিশের সহায়তায় চিহ্নিত চাঁদাবাজরাই নিয়ন্ত্রণ করছে মাদানী এভিনিউ। এ সড়কের জায়গা ভাড়া দেওয়া, পজিশন বরাদ্দ আর চাঁদাবাজির মাধ্যমেই প্রতি মাসে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে ৬০ লক্ষাধিক টাকা। চাঁদার প্রধান দুটি ভাগ যায় থানা পুলিশ ও স্থানীয় কয়েক নেতার পকেটে। টাকার অপর একটি অংশের টাকা মাসোয়ারা হিসেবে পাঠানো হয় রাজউক ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) পাঁচ কর্মকর্তার টেবিলে। বাকি টাকা মাঠপর্যায়ের চাঁদাবাজ লাইনম্যানরা ভাগ-বণ্টন করে নেয়। মোটা অঙ্কের এ চাঁদাবাজি জিইয়ে রাখতেই মাদানী এভিনিউকে দখলমুক্ত হতে দেওয়া হয় না। মাদানী এভিনিউয়ের দুই কিলোমিটার এলাকাকে চারটি সেক্টরে ভাগ করে দেদার চলে চাঁদাবাজি। এর মধ্যে এ রোডে নিষিদ্ধ অটো চালানো বাবদ প্রতিদিনই আদায় করা হয় অন্তত ৫০ হাজার টাকা। থানার অদূরে দাঁড়িয়েই লাইনম্যান শহিদুল ইসলাম শহীদ প্রতি অটোরিকশা থেকে ১৮০ টাকা হারে চাঁদা হাতিয়ে নিয়ে থাকেন। চাঁদা প্রদানে অস্বীকৃতি জানালে তার আর রেহাই নেই। লাইনম্যান শহীদের পক্ষ হয়ে ছুটে আসে ভাটারা থানার পুলিশ। ১০০ ফুট রোডের সাঈদনগর রাস্তা মোড় এলাকার সিএনজি-অটোরিকশা স্ট্যান্ডসহ ফুটপাথ বাজারের যাবতীয় চাঁদা হাতিয়ে নেন জনৈক আজিবর। ১০০ ফুট রোডের বড় ঝামেলা হিসেবে আছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। ব্যাটারিচালিত নিষিদ্ধ শত শত অটোরিকশার ধকল চলে ভাটারার সর্বত্র। এসব রিকশা মাদানী এভিনিউয়ে গেলেই চাঁদা হাতিয়ে নেন লাইনম্যান সালাম। প্রতিটি অটোরিকশা থেকে ৫০ টাকা হারে দৈনিক চাঁদা ওঠে ১৫ সহস্রাধিক টাকা। লাইনম্যান আবদুস সালাম চাঁদাবাজির পাশাপাশি অবৈধভাবে গড়ে তুলেছেন বড় আকারের ‘বৈদ্যুতিক চার্জিং পয়েন্ট’। খ্রিস্টান স্কুল-সংলগ্ন তার গ্যারেজে চোরাই বিদ্যুতের মাধ্যমে রাত-দিন চলে অটোরিকশার ব্যাটারির চার্জ। বিদ্যুৎ চার্জের ফি বাবদ একেকটি অটো থেকে দেড় হাজার টাকা হারে প্রতি মাসে সাড়ে চার লাখ টাকা আদায় করেন লাইনম্যান সালাম। তিনি ডেসকোর স্থানীয় দুই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার পকেটে ৬০ হাজার এবং ভাটারা থানা পুলিশকে ৫০ হাজার টাকা মাসোয়ারা দেওয়ার মাধ্যমে বিদ্যুৎ চুরির অবৈধ বাণিজ্য বহাল রাখছেন। ভাটারা থানার ঠিক বিপরীত পাশেই ফায়ার সার্ভিস কার্যালয়ের গেট রিকশা-অটোর স্থায়ী টার্মিনালসহ ‘ভিড়-ভাড়াক্কার হাটবাজারে’ পরিণত হয়েছে। অবৈধ এ টার্মিনালে ক্ষমতাসীন দলের এক নেতার তত্ত্বাবধানে চাঁদা আদায় করেন জনৈক ঢালী। প্রতিদিন সেখান থেকে ২০ সহস্রাধিক টাকা চাঁদা আদায় হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে থানার সামনে থেকে বিদ্যুৎ গলিসহ আশপাশ এলাকার যাবতীয় চাঁদা তোলা হয় পপির মা খ্যাত সাজেদা বেগমের নামে। থানার পুলিশ ব্যারাকে কাপড়-চোপড় ধোয়ার ‘ঠিকা ঝি’ হওয়ার পর থেকেই দারুণ দাপুটে হয়ে ওঠেন তিনি। শুধু ফুটপাথ চাঁদাবাজির টাকায় গত তিন বছরে সাজেদা চারটি অটোরিকশার মালিক হয়েছেন। সাঈদনগর আবাসিক এলাকায় বহু দামি প্লটও কিনেছেন তিনি।

দখলবাজরা গিলে খাচ্ছে সব : দখলবাজ সিন্ডিকেট জে ব্লক থেকে শুরু করে মাদানী এভিনিউ, এমনকি প্রগতি সরণির বহু জায়গা জবরদখল করে লাখ লাখ টাকায় ভাড়া দিয়ে চলে। জে ব্লকে রাজউকের নির্ধারিত পার্কটিও গিলে খেয়েছে তারা। সেখানে অন্তত দেড়শ প্লটের বরাদ্দপ্রাপ্ত মালিকদের বিতাড়িত করে প্লটগুলো নিজেদের কব্জায় নিয়েছে দখলবাজরা। সেসব আবাসিক প্লটেই চোরাই মোটর গ্যারেজ, ভাঙ্গারি আড়ত, ফার্নিচার দোকান থেকে শুরু করে মাদকের বাণিজ্য পর্যন্ত ফেঁদে বসেছে তারা। ব্যস্ততম প্রগতি সরণির বারিধারা অংশের ফুটপাথ ও রিকশা লেনের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে দখলবাজরা। তারা সরকারি রাস্তা ও ফুটপাথ পজিশন আকারে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। ফলে ১২০ ফুট প্রশস্ত প্রগতি সরণি দিনে দিনে ৬০ ফুটে নেমে এসেছে। অপ্রশস্ত এ রাস্তার মধ্যেও এক লেন দখল করে বানানো হয়েছে অঘোষিত পার্কিং পয়েন্ট। ফলে নর্দ্দা ওভারব্রিজ থেকে সুবাস্তু টাওয়ার পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার সড়কে প্রায়ই শত শত যানবাহনের দুঃসহ যানজট সৃষ্টি হয়। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ক্ষমতাসীন দল ও সহযোগী সংগঠনের স্থানীয় পর্যায়ের চার নেতা আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তার ফুটপাথ ও রিকশার লেন দখল করে নিয়েছেন। তারা পজিশন আকারে অন্তত ৬০০ দোকান গাড়ি-ফার্নিচারের শোরুম, চায়নিজ রেস্টুরেন্ট, সিকিউরিটি গ্রুপ, ওয়ার্কশপ ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। পজিশন বিক্রি থেকেই তারা হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।

সর্বশেষ খবর