শুক্রবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

দুঃসাহসী এক কমান্ডো ছিলেন সাদমান

রাফসান সাবাব খান

দুঃসাহসী এক কমান্ডো ছিলেন সাদমান

মিলিটারি জীবন যাপনে যারা অভ্যস্ত তাদের মুখে সব সময় হাসি ধরে রাখা অনেকটাই অসম্ভব বলা যায়, কিন্তু এই একটা দিক থেকে সাদমানকে দেখে অবাক হতাম।

ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে ৪৫তম ইনটেকের ক্যাডেট ছিলেন সাদমান। বাবা-মায়ের সঙ্গে ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে    নিজেদের বাড়িতেই বড় হন। গত ২ জানুয়ারি সিলেটে বেসিক প্যারা কমান্ডো কোর্সের অংশ হিসেবে তার চতুর্থ জাম্পটি সম্পন্ন করার পথে না-ফেরার দেশে চলে যান সাদমান। দুর্ভাগ্যক্রমে দুটি প্যারাসুটের একটিও ঠিকমতো কাজ করেনি। ৬০০ মিটার উঁচু থেকে পড়ে আর প্রাণে রক্ষা হয়নি অফিসার ক্যাডেট সাদমানের।

ক্যাডেট জীবনের শুরু থেকেই পুরোটা সময় খুব দুরন্তপনার মধ্যে কাটত তার। স্টাফরা কোনোমতেই তার পিছু ছাড়বার সময় পেতেন না। কিন্তু মাঠে নামলেই দুরন্তপনাটাকে পুরোদস্তুর কাজে লাগাতেন তিনি। খেলার মধ্যে বাস্কেটবল আর ফুটবলই ছিল তার সবচেয়ে প্রিয়। অ্যাথলেটিক্সে ক্লাস এইট থেকেই লং জাম্প, ট্রিপল জাম্প কিংবা কোনো একটি ট্রাক ইভেন্টে মেডেল তার থাকতই। কিন্তু সাদমানের কথা মনে হলেই সবচেয়ে বেশি চোখে ভাসে তার ড্রামস বাজানোর কথা। ইনটেকের সেরা ড্রামার ছিলেন তিনি। বেশ ভালো একটি ব্যান্ড টিম হয়ে গিয়েছিল আমাদের। এখনো মনে আছে শেষ পারফরম্যান্সের দিন ড্রামস্টিক ঘোরাতে ঘোরাতে স্টেজে উঠলেন সাদমান, আর অডিটোরিয়াম-জুড়ে তার সাড়া। তার নিজের বাড়িতেই যখন তাকে শেষ বিদায় জানাতে গেলাম, তার রুমে তখনো ড্রাম সেটটি পড়ে ছিল। চোখের সামনে ভেসে আসছিল ঝাপসা এসব স্মৃতি।

পড়াশোনার দিকে বিশেষ কোনো আগ্রহ ছিল না সাদমান। কিন্তু রেজাল্ট সম সময়ই ধরে রাখতেন কীভাবে যেন। বিশেষ কিছু বিষয়ে খুব আগ্রহ নিয়ে পড়তে দেখতাম তাকে। যেমন ক্লাস ১১-এর দিক থেকে বেশ আগ্রহ নিয়ে শুরু করলেন ইংরেজি নিয়ে কাজকর্ম।

দুরন্ত প্রকৃতির কারণে শিক্ষকদের বকাঝকা খেলেও কখনো খুব মন খারাপ করতে দেখিনি। সব সময় মুখে হাসি থাকত। বরং সাদমান ব্যস্ত থাকতেন বাকি সবাইকে হাসিখুশি রাখতেই। কীভাবে এত কিছুর মাঝেও এতটা হাসিখুশি থাকতেন তা দেখে মুগ্ধ হতাম।

বিএমএতে যাওয়ার ইচ্ছা কতটুকু জোরালো ছিল তা ঠিক জানতাম না। কিন্তু অফিসার ক্যাডেট হিসেবে তার পারফরম্যান্স যে খারাপ হবে না, এটুকু নিশ্চিত ছিলাম। একের পর এক এর প্রমাণও দিয়েছেন বন্ধু সাদমান। শুনেছিলাম বিপিসি কোর্সে নাকি সবাই চান্স পান না। দরকার নিখুঁত ফিটনেসের। নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েই জায়গা করে নিয়েছিলেন সেখানেও। বাবা-মায়ের সামনে ফাইনাল জাম্পের আগে ২ জানুয়ারি রাতের জাম্পটিই ছিল শেষ পরীক্ষা। জাম্প সিকোয়েন্সে শেষ পালা সাদমানের। কেন যেন ঠিক তখনই অঘটনটা ঘটে গেল। নিচ থেকে দেখে নাকি মনে হচ্ছিল একটি ইনডিকেটর লাইট খুব বেশি তাড়াতাড়ি ফল করছে। নিচ থেকে অনেক চিৎকার করা হলো রিজার্ভ প্যারাসুটের কথা বলে। গতি কমল না সাদমানের। মুহূর্তের মধ্যে খবরটা ছড়িয়ে যায় সবখানে। শোক আর বিস্ময়ে কাতর সাদমানের বাবা-মাকে সান্ত্বনা দেওয়া ছিল কঠিন। পরদিন দুপুরে সাদমানের লাশ নিয়ে কোটচাঁদপুর মাঠে ল্যান্ড করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার। এর আগে সিলেটে নামাজে জানাজা সম্পন্ন হয়। কোটচাঁদপুরে বাদ আসর আরেকটি জানাজা হয়। পুরো এলাকার মানুষ এক হয়ে গিয়েছিল শেষবারের মতো একবার সাদমানকে দেখতে। জানাজার পর নিজ বাড়িতেই দাফন করা হয়। কাউকে নিজ হাতে মাটি দেওয়া যে এতটা কষ্টের, তা এভাবে না শেখালেও পারতেন আমাদের এই বন্ধুটি। সাদমানের চলে যাওয়া ছিল অসময়ে। কিন্তু অল্প এই সময়ের মধ্যে অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে গেছেন সাদমান। হাসতে হাসতে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া বলে যদি কিছু থাকে তবে তার দৃষ্টান্ত ছিল ওর জীবনের কঠিন সময়গুলো। একই কোর্সে আমাদের অনেক বন্ধু ওই ইনসিগ্নিয়াটার জন্য জীবন বাজি রেখে অংশ নিয়েছেন। চোখের সামনে একজন বন্ধুকে চলে যেতে দেখেছেন সবাইকে কাঁদিয়ে। কিন্তু তারা পিছপা হননি। সাদমানকে উৎসর্গ করেই ৫ জানুয়ারি শেষ করেছেন এই কোর্সটি, শেষ জাম্পটা সম্পন্ন করার মাধ্যমে। ঠিক এভাবেই আমাদের সবাইকে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাবেন সাদমান, সব সময়, হাসিমুখে।

লেখক : সাবেক ক্যাডেট, ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ।

সর্বশেষ খবর