রবিবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

গবেষণা নিয়ে জালিয়াতি

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দায়সারা কর্মকাণ্ড

আকতারুজ্জামান

দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দায়সারা গবেষণা কার্যক্রম চলছে। চাকরির প্রমোশন পেতে, অযোগ্যরা চাকরি বাগিয়ে নিতে করছেন গবেষণা। ফলে জ্ঞান সৃষ্টি নয়, চাকরি বা প্রমোশনের উদ্দেশ্য হাসিলই গবেষণার মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, দায়সারা গবেষণায় চলছে কপি-পেস্ট, চৌর্যবৃত্তি। জালিয়াতির কারণে চাকরিচ্যুতি, তদন্ত কমিটি গঠন হলেও বন্ধ হচ্ছে না এসব কর্মকাণ্ড। ফলে গবেষণার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করা হলেও এর ফল হচ্ছে শূন্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জ্ঞান অর্জন, জ্ঞান চর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টির জায়গা। জ্ঞান সৃষ্টি করতে হলে গবেষণা হতে হবে। যে মাত্রায় গবেষণা হওয়া দরকার সে মাত্রায় হচ্ছে না। যা হচ্ছে তার অধিকাংশই নিম্নমানের। অনেকেই পদোন্নতির জন্য গবেষণা করছেন। তার মতে, অনেকেই দেশের বাইরের থিসিস পেপার থেকে কপি করে নিজের গবেষণাকাজে ব্যবহার করছেন। এটি এক ধরনের চৌর্যবৃত্তি। তিনি গবেষণার মান বাড়াতে বরাদ্দ বাড়ানোর পক্ষে মত দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গবেষণা চুরিতে পিছিয়ে নেই প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। পিএইচডি থিসিসে (অভিসন্দর্ভ) জালিয়াতি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৪ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নূর উদ্দিন আলোকে চাকরিচ্যুত করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গবেষণাকর্মে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও ভুল তথ্য দেওয়ায় তার পিএইচডি ডিগ্রিও বাতিল করা হয়। ২০১০ সালে ‘দ্য প্র্যাকটিসেস অব মার্কসিজম অ্যান্ড দেয়ার ইমপ্যাক্ট অন মডার্ন ওয়ার্ল্ড : দ্য কেস অব অবজেকটিভাইজেশন’ শীর্ষক গবেষণার জন্য নূর উদ্দিনকে পিএইচডি ডিগ্রি দিয়েছিল ঢাবি সিন্ডিকেট। তার গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন একই বিভাগের অধ্যাপক শওকত আরা হোসেন। আর মূল্যায়ন কমিটিতে ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবদুল মান্নান এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মকসুদুর রহমান। ২০১২ সালের ১ জুন উপাচার্যের কাছে নূর উদ্দিনের পিএইচডি গবেষণাটি পুনর্মূল্যায়নের জন্য আবেদন করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের কয়েক শিক্ষক। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক নাসরিন আহমাদকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করে কর্তৃপক্ষ। তদন্তে গবেষণায় মনগড়া তথ্য সংযোজনের প্রমাণ পাওয়ায় নূর উদ্দিনের পিএইচডি প্রত্যাহারের সুপারিশ করে কমিটি।

এ ছাড়া গত বছর সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সালমা বেগমের বিরুদ্ধে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ ওঠে। অধ্যাপক পদে পদোন্নতির সময় একটি বই ও ছয়টি আর্টিক্যালে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ এনে নিয়োগ কমিটির এক সদস্য ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছিলেন। এর আগে ২০১৩ সালেও সালমার বিরুদ্ধে একই অভিযোগ উঠলে পদোন্নতি আটকে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তখন তদন্ত কমিটির কাছে অভিযোগ স্বীকার করে ক্ষমাপ্রার্থনাও করেছিলেন সালমা। ২০১৫ সালে আরবি বিভাগের তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে গবেষণা চুরির অভিযোগ এনে পদোন্নতি আটকে দেওয়া হয়েছিল। জানা গেছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৫৪৫ জন পিএইচডি ও ২৭৭ জন এমফিল ডিগ্রি অর্জন করেন। এতসংখ্যক পিএইচডি ও এমফিল ডিগ্রি এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হলেও মানসম্মত এবং আন্তর্জাতিক মানের ও চোখে পড়ার মতো গবেষণার সংখ্যা খুব কম। পিএইচডি দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় মান রক্ষা করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। ঘরে বসে কিংবা অন্য কোনো চাকরির সঙ্গে যুক্ত থেকে প্রয়োজনীয় গবেষণাকর্ম ছাড়াই এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, মোস্তফা কামাল নামে একজন নিয়ম ভঙ্গ করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ডিগ্রি বাগিয়ে নিয়েছেন। দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৫৩তম হওয়ার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে সরাসরি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ পেতে হলে তিন বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ থাকলেও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা দিয়ে চাকরি বাগিয়ে নেন তিনি। এখানেই শেষ নয়, অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে নিয়ম ভঙ্গ করাই তার প্রধান কাজ হয়ে ওঠে। আইন অনুযায়ী তিন বছরের আগে পিএইচডি থিসিস জমা দেওয়ার নিয়ম না থাকলেও তিনি দুই বছরেই পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। শুধু তাই নয়, পিএইচডি করতে হলে ন্যূনতম ৫০ শতাংশ নম্বরের বাধ্যবাধকতা থাকলেও তার প্রাপ্ত নম্বর মাত্র ৪৬ শতাংশ। এ ব্যাপারে জানতে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তথ্য জানতে বলেন। পরে বলেন, এসব অভিযোগ সত্য নয়। আর অভ্যন্তরীণ প্রার্থীর ক্ষেত্রে নম্বর কোনো বিষয় নয় বলেও মন্তব্য করেন। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাপত্র জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা নিয়েছে সিন্ডিকেট। নম্বরপত্র ঘষামাজা ও গবেষণাপত্র জালিয়াতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ফলিত গণিত বিভাগের অধ্যাপক শামসুল আলম সরকারকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা এবং পরীক্ষাসংক্রান্ত কাজে আজীবন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পাশাপাশি জালিয়াতির দায়ে একই বিভাগের রফিকুল ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধন ও গবেষণাপত্র বাতিল করা হয়েছে। এ ছাড়া গবেষণাপত্রে জালিয়াতির দায়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কৃষ্ণপদ মণ্ডলকে ১০ বছরের শাস্তি দেওয়া হয়েছে। অভিযুক্ত শিক্ষক অন্য শিক্ষকের গবেষণাকর্ম নিজের নামে চালিয়ে দেন বলে জানা গেছে। এই সঙ্গে গবেষণাকর্ম জালিয়াতির শাস্তি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের শিক্ষক ড. অসিত রায়কে প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকে বিরত রাখা হয়েছে। একইভাবে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা একসময় পাণ্ডিত্য অর্জন করে দেশ-বিদেশে সুনাম কুড়ালেও বেশ কয়েক বছর ধরে তা হয়ে উঠছে না। অন্তঃসারশূন্য গবেষণা না আসছে গবেষকের কোনো কাজে, না হচ্ছে জাতীয় উন্নয়ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির নিচ তলায় রাখা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গবেষণাপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে গবেষকদের গবেষণাপত্রের শিরোনাম। গবেষণাপত্রের ওপরের মলাটে লেখা আছে কুষ্টিয়া অঞ্চলে পীর-মাশায়েখদের ‘ইসলাম প্রচারের ভূমিকা’, ‘মাগুরা অঞ্চলে কৃষিতে পাওয়ার টিলারের ভূমিকা’, ‘বৃহত্তর যশোরের জমিদার ও জমিদারি (১৭৯৩-১৯৫০) একটি সমীক্ষা’ শীর্ষক গবেষণা। এ রকম মুখরোচক গবেষণা করেই শিক্ষক পদের অযোগ্য কেউ কেউ বনে গেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশকিছু গবেষক তাদের নিজেদের গবেষণাপত্র অন্য শিক্ষকদের দ্বারা টাকার বিনিময়ে লিখিয়ে নিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগের অধ্যাপক ড. অরবিন্দ সাহা টাকার বিনিময়ে গবেষকদের গবেষণাপত্র লিখে দেন। ব্যবস্থাপনা বিভাগের দুই শিক্ষক এবং আইন ও মুসলিম বিভাগের শিক্ষক ড. খন্দকার তৌহিদুল আনাম তমালের পিএইচডির গবেষণাপত্র তিনি টাকার চুক্তিতে লিখে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদধারী এক অধ্যাপকের পিএইচডি ডিগ্রির ব্যাপারে জালিয়াতির অভিযোগ ওঠায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা রয়েছে। ধর্মতত্ত্ব অনুষদভুক্ত বিভাগগুলোয় এমফিল, পিএইচডি গবেষণার ক্ষেত্রে কপি পেস্টের অভিযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান এসব বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, শিক্ষকদের দায়সারা গবেষণা না করে মৌলিক গবেষণায় গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কারণ এতে জ্ঞান সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তিনি জানান, গবেষণা জালিয়াতিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা নেবে। গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করতে গত বছর এ খাতে বরাদ্দ ৭৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর