মঙ্গলবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

অভিবাসনের আড়ালে হচ্ছে মানব পাচার

মাহবুব মমতাজী

অধিক আয়ের জন্য বিদেশে কাজের সন্ধানে পাড়ি জামান নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির কিছু মানুষ। তাদের এই প্রত্যাশাকে কাজে লাগিয়ে প্রতারণা করছে এক শ্রেণির দালাল। যারা জাল ভিসা ও নিষিদ্ধ দেশে বেশি বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে গ্রামের সহজ-সরল মানুষকে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। বিদেশে পাঠানোর সময় বলা হয় এক দেশের কথা, কিন্তু বিমানবন্দরে টিকিট ধরিয়ে দেওয়া হয় আরেক দেশের। পরবর্তীতে সেসব মানুষকে জিম্মি করে তাদের পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা হয় মোটা অঙ্কের টাকা। এভাবেই চলে অভিবাসনের আড়ালে মানব পাচারের অসাধু ব্যবসা। আর এ কাজে সহায়তা করেন বিভিন্ন দূতাবাসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা।

সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার শাহপরী এলাকার জুবায়ের ও তার খালাত ভাই মামুনের কাজের উদ্দেশে যাওয়ার কথা ছিল স্পেনে। এ জন্য মামুন যোগাযোগ শুরু করেন তার দুঃসম্পর্কের এক মামা ওয়াহিদুর রহমানের সঙ্গে। সবকিছু ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেন ওয়াহিদ। প্রথম দফায় জুবায়েরের কাছ থেকে নিয়ে ছিলেন এক লাখ টাকা। আর মামুনের কাছ থেকে নেন তিন লাখ টাকা। গত বছরের অক্টোবরে তাদের সিলেট থেকে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ উপজেলার সাইনবোর্ডে আসতে বলেন ওয়াহিদ। সেখানে একটি ঘরে রাখা হয় জুবায়ের ও মামুনকে। সপ্তাহখানেক পর স্পেনে যাওয়ার সব বন্দোবস্ত হয়ে গেছে জানিয়ে জুবায়েরকে টিকিট-পাসপোর্টসহ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিয়ে যান ওয়াহিদ। এ সময় মামুনকে বলা হয়- তার কাজটি হতে দু-তিন দিন সময় লাগবে। তবে বিমানবন্দরে জুবায়েরকে স্পেনের বদলে ধরিয়ে দেওয়া হয় তুরস্কের ইস্তাম্বুলের টিকিট। জুবায়েরকে ইস্তাম্বুলের মাধ্যমে লিবিয়া পাঠিয়ে দেন ওয়াহিদ। পৌঁছানোর পরই জিম্মি করা হয় জুবায়েরকে। ওয়াহিদের সঙ্গে থাকা হানিফ ও মিলন জুবায়েরের মাকে মোবাইল ফোনে জানিয়ে দেয় জুবায়ের বন্দী আছে। তাকে ছাড়ানোর জন্য দুই লাখ টাকা দিতে হবে। হানিফ ও মিলনের লিবিয়ায় থাকা কিছু লোক তাকে জিম্মি করে। দুই লাখ টাকা দেওয়ার পর ফের সাড়ে তিন লাখ টাকা দাবি করে হানিফ-মিলন এবং লিবিয়া থেকে জুবায়েরের সঙ্গে তার মার কথা বলে দেওয়া হয়। এমনিভাবে জুবায়েরের পরিবারের কাছ থেকে মোট সাড়ে ছয় লাখ টাকা আদায় করে ওয়াহিদের লোকেরা। একইভাবে নোয়াখালীর জহিরকে অবৈধভাবে পাচার করেছে শামসু ও কামাল নামের দুই দালাল। সাইনবোর্ড থেকে র‌্যাবের অভিযানে উদ্ধারের পর এই দুঃসহ কাহিনীর বর্ণনা দিয়েছেন জুবায়েরের খালাত ভাই মামুন। তাকে ১৮ ডিসেম্বর এক অভিযানে উদ্ধার করে র‌্যাব-৩। এ সময় ওয়াহিদ, সুব্রত, হানিফ ও মিলনকে আটক করা হয়। মামুন জানান, র‌্যাব অভিযান চালিয়ে আমাকে উদ্ধার করেছে। পরে র‌্যাব জুবায়েরকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করে। সঙ্গে সোহেল নামে আরও একজনকে উদ্ধার করেছে। তারা লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের হেফাজতে রয়েছে। র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, প্রতি সপ্তাহে অবৈধভাবে লিবিয়ায় প্রায় ১০০ লোক যাচ্ছে। পরবর্তীতে তারা জিম্মি হওয়াসহ নানা সমস্যায় পড়ছেন। ভিসা জাল করা হয়। যা ইমিগ্রেশনেও ধরা পড়ছে না। যে কোনো দেশের ভিসায় গোপন নম্বর এবং এক ধরনের অদৃশ্য ছাপ থাকে যা খালি চোখে দেখা যায় না। দেখতে বিশেষ ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করতে হয়। দালাল চক্রের সদস্য হাসান অন্য ভিসার গোপন নম্বরটি বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে দেখে জাল ভিসায় এক রকমের গোপন নম্বর ও জল ছাপ বসিয়ে দেয়। জাল ভিসার পর টিকিটের কাজটি আবদুল্লাহ ট্রেডিং এস্টাবলিশমেন্ট নামে এক এজেন্সির মাধ্যমে জামান জালালী করে থাকে। জামান জালালী ও রমজান হলো মানব পাচারের মূল হোতা। তাদের সহায়তা করেন দূতাবাসের কিছু কর্মকর্তা। আবদুল্লাহ ট্রেডিং এস্টাবলিশমেন্টের মোশাররফ হোসাইন বলেন, আমাদের এখানে কিংবা বাইরে থেকে টিকিট করা যায়। এ কাজ স্টাফরা করে থাকেন। অভিবাসনের কথা বলে এ ধরনের প্রতারণার অভিযোগ পাওয়ার পর ১৭ জনকে আটক করেছে র‌্যাব-৩। তাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয় ২১টি দেশি-বিদেশি পাসপোর্ট, এক হাজার ৯৮১টি জাল ভিসাসহ নানা মালামাল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, যেসব বিএমইটি ইমিগ্রেশন কার্ড বিমানবন্দরে অব্যবহূত হওয়ায় ফেলে দেওয়া হয় সেগুলো এনে কার্টন রিবন দিয়ে অন্যজনের পরিচয়ের ছাপ দিয়ে জাল কার্ড বানায়। এ কাজ করা হতো ফকিরাপুলের একটি দোকানে বসে। র‌্যাব-৩ এর ডেপুটি ডিরেক্টর মেজর ফাহিম আদনান সৃিদ্দিকী জানান, র‌্যাবের তত্ত্বাবধানে ১৮ জানুয়ারি জহিরকে দেশে ফেরত আনা হবে। আর কারা পাচারের সঙ্গে জড়িত তাদের খুঁজে বের করা হবে। লিবিয়ায় অবস্থানরত দাউদ মাতব্বর, নিশিথ কুমার দাস, আনোয়ার মুকুল, মুত্তাকিম ও মুসলিমসহ সংঘবদ্ধ চক্রটি বাংলাদেশিদের জিম্মি করে টাকা আদায় করে থাকে। তাদের এ দেশের দোসরদের ধরার চেষ্টা করছি। তবে দালালরা লোক পাঠায় স্বল্প সময়ে যেসব দেশে যাওয়া বৈধ নয় সেসব দেশে। এ জন্য মানুষের সচেতনতার পাশাপাশি বিমানবন্দরের মনিটরিং বাড়াতে হবে। রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেন্ট মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু) সূত্রে জানা গেছে, বহুসংখ্যক বাংলাদেশি দালালের সহযোগিতায় সুদানের জন্য ট্যুরিস্ট ভিসা সংগ্রহ করে। সেখান থেকে বেনগাজি হয়ে লিবিয়ায় অভিবাসন করছে। রাজনৈতিক ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার পরও ২০১৬ সালে ইরাকে ৪ হাজার ৭১৪ জন বাংলাদেশি অভিবাসন করেছে। আর লিবিয়ায় বৈধ পথে কোনো অভিবাসন হয়নি। এ বিষয়ে জনশক্তি রপ্তানি সংস্থার (বায়রা) সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমীন স্বপন বলেন, মানব পাচারের কাজটি করে কিছু সিন্ডিকেট। যদি আমাদের তালিকাভুক্ত এজেন্সির নাম আসে তাহলে সেটি খতিয়ে দেখা হবে।

সর্বশেষ খবর