বুধবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা
দেখার কেউ নেই

রাত নামলেই চাঁদাবাজির বিভীষিকা

আশুলিয়ায় রক্ষকই যখন ভক্ষক

সাঈদুর রহমান রিমন, আশুলিয়া থেকে ফিরে

রাত নামলেই চাঁদাবাজির বিভীষিকা

আশুলিয়ায় রাত নামে চাঁদাবাজির বিভীষিকা নিয়ে। আঁধার ঘনিয়ে আসতেই সড়ক-মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে জড়ো হয় সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজরা। একশ্রেণির পুলিশ কর্মকর্তার যোগসাজশে তারা হয়ে ওঠে অতি ভয়ঙ্কর, রাতের আততায়ী। আশুলিয়ায় ঢুকলে এ চাঁদাবাজ-আততায়ীদের ভয়ে তটস্থ থাকেন যানবাহন চালকরা। পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, পিকআপ, লেগুনা থেকে শুরু করে দূরপাল্লার কোচগুলোও পুলিশি চাঁদাবাজি থেকে রেহাই পায় না। থানার ১০টি পয়েন্টে প্রতি রাতে ১০-১২ লাখ টাকা চাঁদাবাজি চলে বলে অভিযোগ রয়েছে। আশুলিয়া থানার পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশ পৃথক চেকপোস্ট বসিয়ে এসব বখড়া আদায় করে থাকে। দিনভর সর্বত্র যেনতেনভাবে চাঁদাবাজি চললেও রাতে চাঁদাবাজ পুলিশ সদস্যরা রাস্তায় নামেন ডাকাতের ভূমিকায়।

তারা রংবেরঙের টর্চলাইটের উজ্জ্বল আলো ফেলে চলন্ত বাস-ট্রাকগুলোকে রাস্তার পাশে লাইন ধরিয়ে দাঁড় করায়। এরপর পুলিশের পক্ষে দালালের ভূমিকায় থাকা সোর্সরা প্রতিটি চালকের পাশে গিয়ে ধার্যকৃত বখড়ার জন্য হাত বাড়ায়। বিনা বাক্য ব্যয়ে সোর্সের হাতে টাকা তুলে দিলেই টর্চলাইটের সবুজ আলো ফেলে চাঁদা পরিশোধকারী গাড়িকে গন্তব্যে যেতে ইঙ্গিত দেওয়া হয়। এভাবেই প্রতিটি পয়েন্টে সারা   রাত ধরে বিরতিহীনভাবে চলে চাঁদাবাজি। তাদের ‘শকুন চোখ’ ফাঁকি দিয়ে একটা গাড়িও চাঁদা পরিশোধ না করে পার পাওয়ার কোনো নজির নেই। এই চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে হৈচৈ, চিল্লাফাল্লা, ছোটাছুটি আর পুলিশের অবিরাম হুইসেলের শব্দে রীতিমতো আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আশুলিয়ায় পুলিশের বিরুদ্ধে মোট ১০টি স্পটে চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ছয়টি স্পটে আশুলিয়া থানা পুলিশ ও চারটি স্পটে হাইওয়ে পুলিশ এ চাঁদাবাজি চালিয়ে থাকে। স্পটগুলো হচ্ছে—ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বিশমাইল, নয়ারহাট, নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের ইপিজেড, শ্রীপুর, জিরানী, বাড়ইপাড়া এবং বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর রোডের বাইপাইল ব্রিজ মোড়, জামগড়া ও আশুলিয়া ব্রিজ-সংলগ্ন পশ্চিম পাশ। এসব স্থানে পুলিশের চেকপোস্টগুলো রয়েছে। মালবাহী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, কাঠের গাড়ি, বাঁশের গাড়ি, রডের ট্রাক চেকপোস্টে পৌঁছলেই গাড়ি ও মালামালের কাগজপত্র যাচাইয়ের নামে শুরু হয় হয়রানি। এ সময় বিভিন্ন অজুহাতে চালকদের কাছ থেকে ৫০০ থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হয়। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানানো চালকের হয়রানির শেষ থাকে না। সারা রাত গাড়ি আটকে রাখা, চালককে চড়-থাপ্পড়-লাথি মারা, মিথ্যা সন্দেহের দোহাই দিয়ে ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের সমুদয় মালামাল নামানোসহ নানা রকম মামলার ভয়ভীতি দেখানো হয়। ভুক্তভোগী চালক, প্রত্যক্ষদর্শীসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, আশুলিয়া থানার ওসির আস্থাভাজন কালু, আনিস, সালাম, লেহাজউদ্দিন, বাবু, মামুনসহ ১২-১৩ জন সোর্সের বেপরোয়া চাঁদাবাজির হাত থেকে কারও রেহাই মেলে না। মালবাহী কোনো ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও গাছের গাড়ি দেখলে কাগজ পরীক্ষার নামে থামানো হয়। গাড়িটির চাবি কবজায় নেয় দালালরা। এ সময় হাতে-পায়ে ধরা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না চালকদের। শিল্পনগরী আশুলিয়ার সর্বত্রই চলছে বেপরোয়া চাঁদাবাজি। সেখানে চাঁদাবাজরাই সর্বেসর্বা। বিভিন্ন পয়েন্টে চাঁদাবাজরা মিলেমিশে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। থানা পুলিশ, ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় নেতা-কর্মী, নামধারী পরিবহন শ্রমিক নেতা ও স্থানীয় পর্যায়ের মাস্তান-সন্ত্রাসীদের যৌথ চাঁদাবাজ গ্রুপ রীতিমতো ছিনতাই স্টাইলে চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে। একশ্রেণির ভুয়া সাংবাদিক এই চাঁদাবাজদের অন্যতম সহযোগী হিসেবে কাজ করে থাকে। অনুসন্ধানকালে দেখা যায়, বাইপাইল মোড়ে হরদম চাঁদাবাজি চালান ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। সেখানে সার্জেন্টদের নিয়োগকৃত হারুন, নূরু, মনির, বাহার, আবুলসহ কয়েকজন দালাল ব্যস্ততম রাস্তার মোড়ের ওপর দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যেই চাঁদাবাজি চালিয়ে থাকে। ট্রাফিক পুলিশ হুইসেল বাজিয়ে রাস্তার মাঝখানে গাড়ি থামিয়ে দিতেই বাকি দায়িত্ব পালন করে দালালরা। আবার কখনো চলন্ত গাড়িতে চালকের আসন-সংলগ্ন জানালায় বিপজ্জনক অবস্থায় ঝুলতে থাকে দালাল, বাড়িয়ে দেয় চাঁদার হাত। বাইপাইল মোড়ে শুধু ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, পিকআপই নয়, বাস-মিনিবাস, মাইক্রো-প্রাইভেট, লেগুনা, অটোরিকশা, এমনকি মালামাল বোঝাই রিকশাভ্যানও চাঁদাবাজি থেকে নিস্তার পায় না। সেখানে যাত্রী ওঠানামাকারী দূরপাল্লার কোচ থেকেও ৫০-১০০ টাকা আদায় করা হয়। বাইপাইল পয়েন্ট থেকেই ট্রাফিক পুলিশ প্রতি মাসে প্রায় ৪৫ লাখ টাকা চাঁদা তোলে বলে অভিযোগ রয়েছে। পরিবহন চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় খাত হচ্ছে ট্রাফিক টোকেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাইপাইল ট্রাফিক ফাঁড়ি থেকেই সচল রাখা হয় এ টোকেন-বাণিজ্য। ২০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকার বিনিময়ে এসব টোকেন বিতরণ করা হয় মাসোহারার চাঁদা আদায়ের রসিদ হিসেবে। বিশ্বকাপ, উড়োজাহাজ, ছাতা, হেলিকপ্টার, আনারসসহ বিভিন্ন প্রতীকের টোকেন দেওয়া হয় দূরপাল্লার কোচ, স্থানীয় ট্রাক, লোকাল বাস-মিনিবাস, লেগুনা, সিএনজি ও রেন্ট-এ-কারের প্রাইভেট-মাইক্রোগুলোতে ধার্য মাসোহারা অনুযায়ী। আশুলিয়া থানা এলাকায় নিয়মিত চলাচলকারী দুই সহস্রাধিক গাড়িতে মাসোহারা টোকেনের মাধ্যমে ট্রাফিক বিভাগ প্রতিদিন হাতিয়ে নেয় ১০ লক্ষাধিক টাকা। বাইপাইল মোড়ে চাঁদাবাজির অভিযোগে এর আগে সার্জেন্ট সোহেল আহম্মেদ, কনস্টেবল তোফাজ্জল হোসেন, ফখরুল ইসলাম, মোস্তফা মিয়া ও রফিকুল ইসলাম নামে চারজনকে প্রত্যাহার করা হয়। পরে শোকজসহ আরও তিনজন সার্জেন্টকে বিভাগীয় শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও বাইপাইলকে চাঁদাবাজি মুক্ত করা যায়নি। পরিবহন চাঁদাবাজির খাতে ট্রাফিক বিভাগ ছাড়াও হাইওয়ে পুলিশের দুটি টহল টিমের দৌরাত্ম্যের অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী চালকরা। তবে পরিবহন চাঁদাবাজিতে শীর্ষস্থানের রেকর্ড গড়েছেন আশুলিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহসিনুল কাদির। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, তিনি আশুলিয়ায় ওসি হিসেবে যোগদানের পর থেকেই থানা এলাকাজুড়ে স্লোগান ছড়িয়ে পড়ে—‘চাকা ঘুরলে টাকা ওসির’। বাস্তবেই আশুলিয়ার সর্বত্র চাঁদাবাজি যেন বৈধ রূপ পেয়ে গেছে। সেখানে এক-দেড় কিলোমিটার রাস্তায় চলাচলকারী ব্যাটারিচালিত রিকশাকেও দৈনিক হারে পুলিশি চাঁদা দিতে হয়। ওসির পক্ষে যানবাহনের চাঁদা আদায়কারী দালালদের সূত্রে জানা যায়, আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ১০ হাজার নিষিদ্ধ অটোরিকশা চলাচল করে থাকে। প্রতিটি অটো থেকে দৈনিক ৫০ টাকা হারে পুলিশি চাঁদা ওঠে ১০ লাখ টাকা। স্থানীয়ভাবে মাটি বহনকারী চলাচলের অনুপযোগী পাঁচ শতাধিক ট্রাক রয়েছে আশুলিয়ায়। এসব ট্রাক সচল রাখতে মাসিক তিন হাজার টাকা করে অগ্রিম চাঁদা পৌঁছাতে হয় থানায়। ফলে ভাঙাচোরা ট্রাকের খাত থেকেই প্রতি মাসে থানার নামে ১৫ লক্ষাধিক টাকা চাঁদা ওঠে। আশুলিয়া থানার পুলিশ সর্বোচ্চ অঙ্কের চাঁদা পায় শিল্পাঞ্চলের পণ্য বহনকারী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও লং ভেহিকল থেকে। ঢাকা ইপিজেডসহ আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল থেকে তৈরি পোশাক নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরগামী রওনা দেওয়া প্রতিটি ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান থেকে পুলিশ বখড়া পায় এক হাজার টাকা করে। গার্মেন্ট ব্যবসায়ী সূত্রগুলো জানায়, হরতাল-ধর্মঘট না থাকলে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল ও ঢাকা ইপিজেড থেকে পণ্য বোঝাই করে প্রতিদিন ছেড়ে যায় অন্তত ৬০০ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান। রপ্তানিমুখী এসব পণ্যবাহী ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান থেকে প্রতিদিন থানার নামে বখশিশ-বখড়া হিসেবে তোলা হয় ছয় লাখ টাকা। অন্যদিকে মেশিনারিজসহ কাঁচা মালামাল নিয়ে প্রতিদিন আট শতাধিক ট্রাকের আগমন ঘটে আশুলিয়ার শিল্পাঞ্চলে। এসব ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও লং ভেহিকল কোনো কারখানা গেটে পৌঁছালেই চালকের পকেট থেকে ৫০০ টাকা করে হাতিয়ে নেওয়া হয়। কারখানা গেটেই দৈনিক চাঁদাবাজি ঘটে প্রায় চার লাখ টাকার। এ হিসাবে শিল্পাঞ্চল-সংশ্লিষ্ট পণ্যবাহী যানবাহন থেকে থানা পুলিশ প্রতি মাসে হাতিয়ে নেয় প্রায় তিন কোটি টাকা। এসব ছাড়াও অবৈধ টার্মিনাল, সড়ক-মহাসড়ক দখল, চোরাই গাড়ি চলাচল, বাস-মিনিবাস-লেগুনা স্ট্যান্ড, দেড় শতাধিক পরিবহন এজেন্সি, শতাধিক কোচ কাউন্টারসহ অন্যান্য খাত থেকে মাসোহারা হিসেবে প্রতি মাসে আরও ৩০ লক্ষাধিক টাকা চাঁদা পায় পুলিশ। পাশাপাশি প্রতি রাতেই থানার নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সড়ক-মহাসড়কে চারটি চেকপোস্ট বসিয়ে খোলামেলাভাবে চাঁদাবাজি চালিয়ে থাকে। ওসির পক্ষে থানায় চাঁদার টাকা গ্রহণকারী হিসেবে রয়েছেন কনস্টেবল মামুন ও কনস্টেবল ফিরোজ। থানা-সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, প্রতি মাসে পরিবহন খাত থেকে প্রায় আট কোটি টাকা চাঁদা আদায় হয়। কিন্তু এর অর্ধেকেরও বেশি টাকা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করার নামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। জেলা পুলিশ প্রশাসনসহ পুলিশ সদর দফতর ম্যানেজ করার নামে সিংহভাগ টাকা হাতিয়ে নেন ঢাকা জেলার এডিশনাল এসপি আশরাফুল আজিম। অবশ্য জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের অপর একটি সূত্র দাবি করে জানায়, ‘থানার কোনো সিস্টেমের টাকা এডিশনাল এসপি নিজে খান না, টাকা যথাযথ স্থানেই পাঠিয়ে দেন তিনি।’

সর্বশেষ খবর