বুধবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

শঙ্কা কাটিয়ে মূলধারায় নতুন ব্যাংকগুলো

—— এমডি, মেঘনা ব্যাংক

আলী রিয়াজ

শঙ্কা কাটিয়ে মূলধারায় নতুন ব্যাংকগুলো

নুরুল আমিন

‘নতুন প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকগুলো মূলধারায় চলে এসেছে। নতুন ব্যাংক হিসেবে যেসব বাধা থাকে সেগুলো কাটিয়ে উঠেছে ব্যাংকগুলো। এখন আর্থিক কর্মকাণ্ডের মুনাফার ভাগ তারা নিতে শুরু করেছে। গত বছর সব ব্যাংকই ভালো মুনাফা করেছে। আর্থিক সক্ষমতা এখনো গড়ে না উঠলেও দ্রুত সেখানে পৌঁছে যাবে। সব শঙ্কা কাটিয়ে বলা যায় ব্যাংকিং কর্মকাণ্ডে পুরোপুরি সক্ষমতা অর্জন করেছে নতুন ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে নতুন প্রতিষ্ঠান হিসেবে মেঘনা ব্যাংক শীর্ষে রয়েছে। নতুন আইডিয়া, প্রডাক্ট নিয়ে আমরা গ্রাহকদের কাছে পৌঁছেছি। কয়েক বছরের মধ্যে আমরা দেশের অন্যতম ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাব।’ দেশের ব্যাংকিং পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনের মুখোমুখি হয়ে এসব কথা বলেন মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. নুরুল আমিন। প্রায় ৩০ বছরের ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে একাধিক ব্যাংকের এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন নুরুল আমিন। ব্যাংক ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সংগঠন এবিবির সভাপতিও ছিলেন। সর্বশেষ সাফল্যের সঙ্গে এনসিসি ব্যাংকের এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে ২০১৪ সালে যোগদান করেন মেঘনা ব্যাংকে। দুই বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকের মতো মূলধারায় নিয়ে এসেছেন ব্যাংকটিকে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘নতুন ব্যাংকগুলোর বড় অর্জন শঙ্কা কেটেছে। আমাদের দেশে আগে সংখ্যা বাড়ে, পরে কোয়ালিটি হয়। সব খাতেই এটা প্রযোজ্য। ব্যাংকের ক্ষেত্রে কোয়ালিটি বা মান অর্জন করা দ্রুত হয়। এর কারণ নিয়ন্ত্রক সংস্থা অনেক। বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএসইসি, রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ। এর বাইরে এক্সটারনাল অডিট, ইন্টারনাল অডিট করতে হয়। বছরে দুবার রেটিং করতে হয়। এতগুলো নিয়ন্ত্রক থাকার কারণে অব্যবস্থাপনা থাকার সুযোগ কম। আমি মনে করি, দেশের যে কোনো খাতের চেয়ে ব্যাংকিং খাত সুশৃঙ্খল। ব্যাংকগুলো যদি সঠিকভাবে নিজেদের ব্যবস্থাপনায় কঠোর লক্ষ্য নির্ধারণ করে, তাহলে ব্যর্থ হওয়ার কোনো কারণ নেই।’ তিনি বলেন, ‘নতুন ব্যাংক হিসেবে মেঘনা ব্যাংক গত বছর ১০০ কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে। আমাদের ডিপোজিট ২৬০০ কোটি টাকা। ডিসবার্স হয়েছে ২১০০ কোটি টাকার বেশি। আমরা একটি ভিন্ন রকম ব্যাংক হব। আগামী এক বছরে আমরা ৫০ ভাগ প্রবৃদ্ধি করব। বর্তমানে এ ব্যাংকের ৩৬টি শাখা। এ বছর আরও শাখা খোলা হবে। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর একটি ব্যাংক হিসেবে গ্রাহকদের নিজস্ব ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য আমাদের। মেঘনা ব্যাংক গ্রামীণ কৃষি, এসএমই খাতে জোর দিয়ে অর্থায়ন করছে। একই সঙ্গে করপোরেট ঋণও দিচ্ছে। ঋণ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা বজায় রেখে অর্থায়ন হয়। ফলে আমাদের খেলাপি এক শতাংশের নিচে।’

এবিবির সাবেক সভাপতি বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে বিশাল খেলাপি রয়েছে। নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো চালাতে না পারা সরকারের ব্যর্থতা। ব্যাংকের শীর্ষ ম্যানেজমেন্ট নির্ধারণ এ ক্ষেত্রে বড় সমস্যা। গ্রাহক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আত্তীকরণ, রাজনৈতিক প্রভাব এগুলোর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ব্যাংকের নিয়ন্ত্রক হবে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এতে যদি রাজনৈতিক প্রভাব থাকে তাহলে ব্যাংক চলতে পারবে না। প্রতি বছর তাদের মন্দ ঋণ বাড়ছে। সব ব্যাংক মুনাফা করতে পারে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ব্যর্থ হয়। তাদের যে বিনিয়োগ, তাদের অনেক বেশি মুনাফা করার কথা। কিন্তু তা তারা পারছে না। কয়েকটি তো লোকসান দেখিয়েছে।’ নুরুল আমিন বলেন, দেশের পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থার বর্তমান বড় সমস্যা হচ্ছে, কোর ব্যাংকিং মুনাফা কম। গত বছর সব ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে। কিন্তু এটি কোর ব্যাংকিংয়ের মুনাফা নয়। উৎপাদন খাতের বিনিয়োগ কম। অধিকাংশ ব্যাংকের মুনাফা তাদের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান, কল মার্কেট, শেয়ার পোর্টফোলিও, বৈদেশিক বাণিজ্যের কমিশন, গ্যারান্টি কমিশন। অর্থাৎ ননফান্ডেড ব্যবসা বেশি। এটি ভবিষ্যতে সমস্যা তৈরি করতে পারে। দেশের সবারই একটি প্রবণতা, তা হচ্ছে দ্রুত মুনাফা করা। ব্যাংকগুলো এর বাইরে নয়। বড় বড় প্রকল্পে বিনিয়োগ হয়েছে। দেশীয় পর্যায়ে সার্ভিস খাতে যে বিনিয়োগ হয়েছে, উৎপাদন খাতে হচ্ছে না। ফলে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। বলা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি কমছে। কিন্তু প্রবৃদ্ধি হলে মূল্যস্ফীতি কোনো সমস্যা নয়। এখন উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধি যদি বড় আকারে না হয়, তাহলে এই মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। এনসিসি ব্যাংকের সাবেক এমডি বলেন, ব্যাংকিং ব্যবস্থার মধ্যে ২০১৩ সালের পুনঃ তফসিলে যে সুবিধা দেওয়া হয়েছিল, এর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সে সময় অনেক মন্দ ঋণও পুনঃ তফসিল করা হয়েছে। যারা টাকা ফেরত দেবে না, তারা সুবিধা দিলেও দেবে না, না দিলেও দেবে না। ব্যাংকগুলো পুনঃ তফসিল সুবিধা যেমন দিয়েছে, অবলোপনও বেড়েছে। অন্যদিকে অনেক বড় অঙ্কের বিনিয়োগযোগ্য অলস তারল্য রয়েছে। প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা। ফলে এগুলো অস্থিরতা তৈরি করতে পারে এ বছর। বিশিষ্ট এই ব্যাংকার বলেন, ষাণ্মাসিক মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মুদ্রানীতি বিনিয়োগ নিশ্চিত করে গ্রাহকদেরও সুবিধা দিতে হবে। জোর করে সুদহার কমিয়ে রাখা হয়েছে। এটা ঠিক নয়। সবই বাজার ঠিক করবে। কারও দাবির মুখে সুদহার নির্ধারণ করা উচিত নয়। ব্যবসায়ীদের দাবিতে সুদহার কমানো হলো। ডিপোজিট সুদহার চার শতাংশের নিচে নিয়ে আসা হয়েছে। তাতে তাদের ঠকানো হচ্ছে কিনা দেখা উচিত। কারণ তারা তো দাবি করতে পারছে, যারা সুদহার কমাতে বলেছে। ব্যাংকগুলো টাকা নিয়ে বসে আছে। তারা এখন বিনিয়োগ করছে না কেন? সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণ সুদহার খেলাপি কমছে না। বাংলাদেশে যদি শূন্য শতাংশও ঋণ সুদহার হয়, খেলাপি কমবে না। তাই এ বিষয়ে নতুন করে নজর দেওয়া উচিত। এ ছাড়া যেহেতু ব্যাংকগুলোর হাতে প্রচুর অর্থ রয়েছে, সুদহারও কম, তাই বিদেশি ঋণ কমানো উচিত। বিদেশি ঋণ কমালে দেশের টাকা বিনিয়োগ হবে। সাম্প্রতিক রেমিট্যান্স কমায় মোবাইল ব্যাংকিং দায়ী কিনা তা দেখা উচিত।

সর্বশেষ খবর