শুক্রবার, ২০ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

আতঙ্কের জনপদ আশুলিয়া

পুলিশের সহায়তায় চলছে মাদক-জুয়া ওসি-এএসপির বখরা লাখ লাখ টাকা

সাঈদুর রহমান রিমন, আশুলিয়া থেকে ফিরে

আশুলিয়া এখন আতঙ্কের জনপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে অপরাধীরা নির্বিঘ্ন জীবনযাপন করলেও পেশাজীবী-কর্মজীবী, খেটে খাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, শিল্পপতি সবাই থাকেন আতঙ্কে। ব্যবসা-বাণিজ্যে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী, বিদেশি শিল্পোদ্যোক্তা, পোলট্রি-গবাদিপশু খামারিরা পর্যন্ত পুলিশি ধকলের শিকার হচ্ছেন নানাভাবে। অফিস-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বাসাবাড়ি কোথাও নির্বিঘ্নে জীবন কাটানোর উপায় নেই। চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীদের তৎপরতা, সোর্স নামের দুর্বৃত্তদের দৌরাত্ম্য, সর্বোপরি পুলিশি হয়রানি-নিপীড়নে আশুলিয়াবাসীর নাভিশ্বাস উঠেছে। রাস্তাঘাটে নির্ঝঞ্ঝাট চলাচলের কোনো উপায় নেই। প্রকাশ্য দিবালোকে চলে পকেটমার, ছিনতাই-রাহাজানি আর রাত হলেই পুলিশের তল্লাশি নামের চাঁদাবাজি। কারখানা-ফেরত শ্রমিককেও রাস্তায় আটক করে পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে পুলিশি চাঁদাবাজির ধকলে ফেলা হয়, মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে হয়রানি চলে অহরহ। আশুলিয়া থানা পুলিশের অব্যাহত ঘুষ, চাঁদাবাজি, বখরাবাজির কব্জায় মামলার বাদী-সাক্ষীদেরও রেহাই মেলে না। মামলার এজাহার লেখাতে টাকা লাগে, থানায় তা রেকর্ড করতে টাকা লাগে, ঘটনাস্থলে তদন্ত করাতেও সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তাকে টাকা দিতে হয়, মর্জিমাফিক টাকা দিলে ধরানো যায়, চার্জশিট করাতেও টাকার জোগান লাগে। পুলিশ মহলে ধনাঢ্য থানা হিসেবে খ্যাত আশুলিয়ায় যে কোনো মূল্যে একবার পোস্টিং করাতে পারলেই আর পায় কে! নিছক এসআই-এএসআইদেরও বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, ব্যাংক ব্যালান্স গড়ে ওঠে, ওসিরা বনে যান কোটিপতি। সেখানে যে কোনো কায়দা-কৌশলে জমি মালিকদের বিপাকে ফেলে একখণ্ড জায়গার মালিক হওয়াটা পুলিশ সদস্যদের জন্য নস্যি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মাদক-জুয়ায় ভাসমান : মাদক আর জুয়ায় ভাসছে আশুলিয়া। হাত বাড়ালেই মিলছে মাদক। হাটবাজার, বাসস্ট্যান্ড, শপিং মল, অলিগলির মোড় থেকে শুরু করে থানা-ফাঁড়ির আশপাশেও চলছে মাদকের অবাধ বেচাকেনা। যত্রতত্র বসছে নেশার আসর। পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে চলছে রমরমা জুয়াবাণিজ্য। আবাসিক হোটেল, ফ্ল্যাট, বাগানবাড়ি, কল কারখানার ভিতরে রাতদিন চলে লাখ লাখ টাকার জুয়া। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, মাদক-জুয়া উভয় ক্ষেত্রেই পুলিশের প্রায় প্রকাশ্য যোগসাজশ রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ পাহারায় চলে মাদকের বেচাকেনা, পুলিশের বেষ্টনীতেই বসে জুয়ার বাণিজ্য।

জুয়ার আসর ও মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা পায় একশ্রেণির পুলিশ। সূত্র জানায়, এ দুটি খাত থেকে প্রতি মাসে থানা পাচ্ছে ৬০ লাখ টাকা মাসোহারা। তাই আশুলিয়া থানা পুলিশের মাদক-জুয়ার ব্যাপারে তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। থানা এলাকায় নেই কোনো মাদকবিরোধী অভিযানও। মাঝেমধ্যে ডিবি পুলিশের টহল টিম মাদক ব্যবসায়ীদের আস্তানায় হানা দিলেও মিট-মীমাংসার মধ্য দিয়েই অভিযান শেষ হয়ে যায়। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সার্কেল ইন্সপেক্টরের টিমও নিষ্ক্রিয় পড়ে থাকে, তারাও মাসোহারা আদায়ের মধ্যেই নিজেদের দায়িত্ব-কর্তব্য সীমাবদ্ধ রেখেছে।

জানা যায়, আশুলিয়ায় অর্ধশতাধিক স্পটে ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজাসহ দেশি-বিদেশি নানা নেশাদ্রব্য হামেশা কেনাবেচা চলছে। এর মধ্যে বাড়ইপাড়া বন বিট, কবিরপুর বাজার, মোজার মিল, চক্রবর্তী পুলিশ ফাঁড়ির সামনে; শ্রীপুর চন্দ্রিমা হলের পেছন; ভাদাইল উত্তরপাড়া মতিনের বাড়ি, দক্ষিণপাড়া, পবনার টেক, বাইপাইল মোড়ের পুলিশ বক্সসংলগ্ন মার্কেট ও আশপাশ; বগাবাড়ী বাজার, ইউনিক স্ট্যান্ডসংলগ্ন দক্ষিণ পাশ; জামগড়ার তিনটি পয়েন্ট, পলাশবাড়ীর তিনটি পয়েন্ট, জিরাবো থেকে মাদবরবাড়ী পর্যন্ত পাঁচটি পয়েন্ট, নবীনগর জাতীয় স্মৃতিসৌধের আশপাশে চারটি পয়েন্টে বিক্রি হচ্ছে মাদক। এ ছাড়া কুরগাঁও, বিশমাইল স্ট্যান্ড, আশুলিয়া বাসস্ট্যান্ড, আউকপাড়া বাংলা বস্তি, কাঠগড়া বাজার রোডে দিনে-দুপুরে বাংলা মদ ও গাঁজা উঠতি যুবকদের কাছে বিক্রির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন অর্ধশতাধিক ব্যবসায়ী। আশুলিয়া বাইপাইল দক্ষিণপাড়ায় মাদক ব্যবসা নিয়ে বিক্রেতাদের মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষ বাধে। স্থানীয় বৃষ্টি বেগম, কুলসুম বেগম, বিল্লাল হোসেন ও জুলেখা ওই এলাকাকে মাদক বাণিজ্যের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছেন। এলাকার কেউ এর বিরোধিতা করলে মারধর ও মামলা করে পুলিশ দিয়ে হয়রানি চালান। পুলিশ মাঝেমধ্যে আইওয়াশ হিসেবে দু-চার জন মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করে জেলে পাঠালেও পরমুহূর্তেই তারা জামিনে বেরিয়ে আবারও এলাকায় পুরোদমে ব্যবসা চালিয়ে যান। সরেজমিনে ঢাকা ইপিজেডের পুরাতন জোনে গিয়ে আরও জানা যায়, ডিইপিজেডের পুব পাশের দেয়ালঘেঁষে ট্রাকস্ট্যান্ড ও ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কের পুব পাশে আণবিক শক্তি কমিশনের ওয়ালের সঙ্গে স্থাপিত ঝুপড়ি ঘরগুলোয় প্রকাশ্যে গাঁজা ও হেরোইনের পুরিয়া গার্মেন্ট শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক এবং স্কুল-কলেজের ছাত্রদের কাছে গোপনে বিক্রি করা হচ্ছে।

জুয়ার টাকায় থানা রমরমা : শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায় মহাসড়কগুলোর পাশে প্রতিদিনই প্রকাশ্যে চলছে জুয়ার জমজমাট আসর। সাধারণ মানুষ বিশেষ করে খেটে খাওয়া দিনমজুর ও গার্মেন্ট কর্মীরাই এদের টার্গেট। ভ্যানে করে বিভিন্ন গৃহস্থালির আসবাবপত্র ও নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র দেওয়ার লোভনীয় লটারির আড়ালে একটি অসাধু চক্র প্রতিনিয়ত হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার হাজার টাকা। নিজেদের প্রতারণামূলক কারবার নির্বিঘ্ন রাখতে এসব জুয়ার আসর থেকে নিয়মিত টাকার ভাগ পাঠানো হচ্ছে থানা পুলিশের কাছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিদিন বিকালে নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের পাশ দিয়ে নবীনগর থেকে জিরানী পর্যন্ত ২০টি ও আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল সড়কের বাইপাইল থেকে নরসিংহপুর পর্যন্ত আরও ১০টি ধাপ্পাবাজির জুয়ার আসর বসে। এই প্রতারক চক্রের লোকজন জুয়ার আসর থেকে পকেট কেটে টাকা নেওয়া, জোর করে টাকা রেখে দেওয়াসহ নানা অপকর্ম চালাচ্ছেন। থানা মসজিদের সামনে জনৈক জুয়েল ও তামসা, আল-আমিন মাদ্রাসা ও ইনভেস্টর ক্লাবের সামনে বেল্লাল, সম্ভার পাম্পের সামনে মাহবুব, পলাশবাড়ীতে আরিফ গং এসব জুয়ার আসর পরিচালনা করছে বলে অভিযোগ। এ ছাড়া ইপিজেডের সামনে, বলিভদ্র বাজার, জিরানী বাজারসহ প্রায় ৩০টি স্পটে ওপেন জুয়ার আসর বসে। প্রতিটি জুয়ার আসরে প্রতিদিনই মারামারি, পকেট কেটে টাকা নেওয়া, জোর করে টাকা রেখে দেওয়াসহ ছিনতাই-রাহাজানির মতো নানা অপরাধ ঘটেই চলছে। জুয়া মেলা-সংশ্লিষ্টরা নিজেদের নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রতিটি জুয়ার আসর থেকে প্রতিদিন আশুলিয়া থানার নামে ১০ হাজার টাকা করে বখরা পাঠানো হয়। এ ছাড়া পুলিশের প্রতিটি টহল টিমকে নাস্তা-খাবার দেওয়াসহ ১ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। ফলে থানা পুলিশের চোখের সামনে রমরমা জুয়াবাণিজ্য চললেও পুলিশ তা দেখার প্রয়োজনবোধ করে না। জুয়ার মেলা বন্ধের দাবিতে স্থানীয় মসজিদের মুসল্লিসহ মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকরা প্রতিবাদ মিছিল বের করলে ওসি নিজে তাদের লাঠিপেটা করে হটিয়ে দেওয়ার ঘটনার পর থেকে জুয়ার বিরুদ্ধে কেউ টুঁশব্দটি করতেও আর সাহস পান না। লাখ লাখ টাকার জুয়া খেলা চলে বিভিন্ন বাগানবাড়ি ও আবাসিক ফ্ল্যাটে। বিভিন্ন ব্যবসায়ী, ধনাঢ্য ব্যক্তি, উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ ডিইপিজেডের বিদেশি কর্মকর্তারা নানা স্থানে জুয়ার আসর বসাচ্ছেন। তাস খেলার মাধ্যমে পরিচালিত জুয়ার একেক আসরে ৫০-৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেনের ঘটনা ঘটে। ইপিজেড-সংলগ্ন দুটি মহল্লা, জামগড়া, ডেন্ডাবর, পলাশবাড়ী, বগাবাড়ী বাজারসহ আশুলিয়া থানাঘেঁষা তিনটি ভবনের অন্তত ২০ স্পটে বহু টাকার এই জুয়া চলে। একেকটি আসর থেকে প্রতি রাতে থানার নামে বখরা পাঠানো হয় ৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। থানা পুলিশকে না জানিয়ে গোপনে আরও ৩০টিরও বেশি জুয়ার আসর বসে আশুলিয়ায়। এসব স্থানে পুলিশ অভিযান চালিয়ে টাকাপয়সা সব ছিনিয়ে নিলেও কখনো তা মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জুয়ারিদের থানার লকআপে নিয়ে আটকে রেখে চাহিদামাফিক টাকা আদায় করেই ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে থানার একাধিক সূত্র জানায়, আশুলিয়ার জুয়া-মাদকের বখরা স্থানীয় পুলিশের মধ্যেই ভাগবণ্টন হয়। জেলা পুলিশ সুপার এ ব্যাপারে আপসহীন থাকলেও এ দুই কর্মকর্তার কারণে মাদক-জুয়া নির্মূল করতে পারছেন না বলেও অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর