শুক্রবার, ২০ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা
আশুলিয়া থানার কাণ্ড কীর্তি

আদালতের নির্দেশেও মামলা নেন না ওসি

বিশেষ ক্ষমতা আইনের বিলুপ্ত ধারায় মামলা দিয়ে ১৫ শ্রমিক নেতাকে পাঠিয়েছেন জেলে

আদালত প্রতিবেদক

ঢাকার আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহসীনুল কাদিরের ক্ষমতার দাপটে শত শত বিচারপ্রার্থী অসহায়। আদালত নির্দেশ দিলেও এজাহার গ্রহণ করেন না আশুলিয়া থানার ওসি মোহসীনুল কাদির। অন্যদিকে বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪ এর বিলুপ্ত হওয়া ধারায় ১৫ জন শ্রমিকনেতার বিরুদ্ধে মামলা করে তাদের গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছেন আশুলিয়ার ওসি মোহসীনুল কাদির। ওই ১৫ জনের মধ্যে একজন বর্তমানে কাশিমপুর কারাগারে এবং বাকি ১৪ জন কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী। গত ডিসেম্বরে পোশাক শ্রমিকরা ১৫ হাজার টাকার ন্যূনতম বেতন নির্ধারণের দাবিতে আন্দোলন করায় এসব শ্রমিকনেতার বিরুদ্ধে বিলুপ্ত হওয়া আইনের ধারা প্রয়োগ করা হয়। আশুলিয়া থানার ওসি মোহসীনুল কাদিরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ সেখানকার বাসিন্দারা। বিচারপ্রার্থী মানুষ বিভিন্ন গুরুতর অভিযোগ নিয়ে থানায় হাজির হলেও মামলা নিচ্ছে না পুলিশ। ফলে বাধ্য হয়ে আদালতে মামলা করছেন তারা। এ কারণে ঢাকার আশুলিয়ার আমলি আদালতগুলোতে জমে গেছে মামলার স্তূপ। আদালতে করা এসব মামলার মধ্যে অনেক মামলা আশুলিয়া থানার ওসিকে এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। কিন্তু আদালতের নির্দেশ মোতাবেক আশুলিয়া থানার ওসি মোহসীনুল কাদির মামলার এজাহার গ্রহণ করেননি। এ কারণে বাদীপক্ষের আইনজীবীরা প্রতিকার চেয়ে আদালতে ফের আবেদন করেন। এরপর আশুলিয়া পুলিশ এজাহার গ্রহণ করলেও কিছুদিন পর মনগড়া তদন্ত করে আসামিদের রেহাই দিতে আদালতে অব্যাহতির আবেদন  করছে। এ ছাড়া মিথ্যা মামলা করার অভিযোগ এনে বাদীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার ভয় দেখাচ্ছে আশুলিয়া থানার পুলিশ।

ঘটনা-১ : ঢাকার আশুলিয়ার মির্জানগরের শফিকুল ইসলামের বসতঘরে প্রবেশ করে লোহার রড দিয়ে তাকে মারধর করে গুরুতর আহত করে দুর্বৃত্তরা। এ সময় শফিকুলের স্ত্রীকেও মারধর এবং শ্লীলতাহানি ঘটানো হয়। পরে শফিকুলের বসতঘর থেকে নগদ ৭৩ হাজার টাকা, ছয় ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও দুটি পানির পাম্প লুট করে নিয়ে যায় ওই দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় শফিকুল মামলা করতে গেলে আশুলিয়া থানা অস্বীকৃতি জানায়। পরে সাতজনকে আসামি করে গত বছর ৩ আগস্ট শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে আরজিকে সাত দিনের মধ্যে এজাহার হিসেবে গণ্য করতে আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশ দেন। কিন্তু আশুলিয়া থানার ওসি মোহসীনুল কাদির আদালতের আদেশ মোতাবেক মামলার এজাহার গ্রহণ করেননি। পরে বাদীর আইনজীবী প্রতিকার চেয়ে আদালতে আবেদন করেন। এরপর দুই মাসের বেশি টালবাহানা করে গত বছর ১৪ অক্টোবর মামলাটি এজাহার হিসেবে গ্রহণ করে আশুলিয়া থানা। থানার মামলা নম্বর ৩০(১০)১৬। এরপরই শুরু হয় আসল খেলা। কপাল পোড়ে মামলার বাদী শফিকুলের। আশুলিয়া পুলিশ তদন্ত করে গত বছর ২৭ ডিসেম্বর মামলার সব আসামির অব্যহাতি চেয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। ওই চূড়ান্ত প্রতিবেদন আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহসীনুল কাদির অগ্রবর্তী করেন। এ ছাড়া আশুলিয়া থানার এসআই আশরাফুল আলমের দাখিল করা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মামলার অভিযোগ মিথ্যা। উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিবাদীদের হয়রানি করার জন্য মামলাটি করা হয়েছে। পুলিশ সুপার ঢাকা মহোদয় আমার তদন্তে একমত পোষণ করায় বিবাদীদের অব্যাহতির প্রার্থনা করিলাম। মিথ্যা অভিযোগে মামলা দায়ের করায় বাদীর বিরুদ্ধে কা.বি. ২১১ ধারা মোতাবেক প্রসিকিউশন দাখিলের অনুমতি প্রার্থনা করা হইল।’ এ বিষয়ে বাদীর আইনজীবী মো. আকতারুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ মামলার শুরু থেকেই পুলিশ আসামিদের পক্ষ নিয়েছিল। এ কারণে তদন্তের সময় মামলার বাদী ও সাক্ষীদের কাছে কিছুই জানতে চায়নি পুলিশ। এমনকি মামলার ফলাফল সম্পর্কেও বাদীকে কিছুই না জানিয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। এ ছাড়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা বাদীর বিরুদ্ধে কা.বি. যে ধারায় ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন করেছেন, সেটিও ভুল। ওই ধারায় দণ্ড দেওয়ার কোনো সুযোগ আইনে নেই। এখন বোঝেন, তদন্ত কর্মকর্তার দক্ষতা ও যোগ্যতা কতটুকু! আমরা এ প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন করব।’

ঘটনা-২ : ঢাকার আশুলিয়ার মধুরবাড়ীর ভাড়াটিয়া শাবনূর (ছদ্মনাম)। স্থানীয় একটি ক্যাপ ফ্যাক্টরিতে চাকরি করেন তিনি। অফিসে আসা-যাওয়ার পথে বিভিন্ন সময় তাকে কুপ্রস্তাব দেয় মধুপুরের দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দা খন্দকার বোরহান উদ্দিনের ছেলে কিরণ খন্দকার। চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে মধুপুর মথনেরটেক পৌঁছলে ওতপেতে থাকা কিরণ জোর করে তার মুখ জাপটে ধরে। পরে শাবনূরকে অপহরণ করে স্থানীয় কাঠবাগানের ভেতর নিয়ে জোর করে ধর্ষণের চেষ্টা চালায় কিরণ। এ সময় ভিকটিমের চিৎকারে আশপাশের লোকজন ঘটনাস্থলে এলে কিরণ পালিয়ে যায়। পরে মামলার সাক্ষীরা ভিকটিমকে অর্ধবস্ত্র অবস্থায় উদ্ধার করে। এ ঘটনায় ভিকটিম আশুলিয়া থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ নেয়নি। ফলে তিনি বাধ্য হয়ে ঢাকার ১ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ৮ জানুয়ারি মামলা করেন। আদালতের মামলা নম্বর-৩০/২০১৭। বিচারক বাদিনীর জবানবন্দি শুনে আশুলিয়া থানার ওসিকে নালিশি দরখাস্তকে এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেন। কিন্তু এ মামলা আশুলিয়া থানার ওসি মোহসীনুল কাদির তা এজাহার হিসেবে গ্রহণ করেননি। এ ছাড়া আসামিকে গ্রেফতারেও কোনো পদক্ষেপ নেননি। 

ঘটনা-৩ : আশুলিয়ার জিরাবো ঘোযবাগের মৃত আইয়ুব আলীর ছেলে সোহাগ। পেশায় গাড়িচালক। গত বছর ৩০ ডিসেম্বর বাড়ির পাশের পারিবারিক অনুষ্ঠান শেষ করে বাসায় ফিরছিলেন সোহাগ ও তার ভাই রাজীব। পথে স্থানীয় দুই চাঁদাবাজ পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের গতিরোধ করে। পরে সন্ত্রাসীরা সোহাগকে পিস্তল ঠেকিয়ে বলে, আশুলিয়া এলাকায় গাড়ি চালালে মাসে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হবে। এ সময় প্রতিবাদ করলে চাঁদাবাজরা মারধর করে সোহাগের বাঁ হাতের দুটি আঙ্গুল বিচ্ছিন্ন করে এবং দুই পায়ের হাঁটুর নিচে লোহার পাইপ দিয়ে রক্তাক্ত জখম করে। এ ছাড়া রাজীবকে হত্যার উদ্দেশ্যে মাথায় লোহার পাইপ দিয়ে রক্তাক্ত জখম করে দুর্বৃত্তরা। পরে সোহাগ ও রাজীব ডাকচিৎকার করলে আসামিরা অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে ফাঁকা গুলি করতে করতে চলে যায়। এ ঘটনায় আহতদের আরেক ভাই সজীব আশুলিয়া থানায় আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। ফলে বাধ্য হয়ে সজীব আদালতে মামলা করেন। পরে বিচারক ভিকটিমদের মেডিকেল সার্টিফিকেট, জখমের ছবি, চিকিৎসা-সংক্রান্ত কাগজপত্র দেখে এবং মামলার অভিযোগের গুরুত্ব বুঝে আশুলিয়া থানার ওসিকে তিন দিনের মধ্যে এজাহার গ্রহণের নির্দেশ দেন। কিন্তু তা আমলে নেননি ওসি। এ মামলার আসামিরা আশুলিয়া থানার ওসি মোহসীনুল কাদিরের ঘনিষ্ঠ বলে তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না। এদিকে বিশেষ ক্ষমতা আইনের বিলুপ্ত হওয়া ধারায় ১৫ জন শ্রমিকনেতার বিরুদ্ধে মামলা করে তাদের গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছে আশুলিয়া থানার পুলিশ। গত ডিসেম্বরে পোশাক শ্রমিকরা ১৫ হাজার টাকা ন্যূনতম বেতন নির্ধারণের দাবিতে আন্দোলন করায় শ্রমিক অস?ন্তোষের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় এসব শ্রমিকনেতার বিরুদ্ধে বিলুপ্ত হওয়া আইনের ধারা প্রয়োগ করা হয়। বিজিএমইএ ৫৫টি কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেয় ২০ ডিসেম্বর। ১৯ ডিসেম্বর শ্রমিকনেতারা ‘ষড়যন্ত্র’ বা অপরাধ সংঘটনের চক্রান্ত করেছেন এ অভিযোগ আনে পুলিশ। আশুলিয়ার পুলিশ বাদী হয়ে ১৫ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে যে মামলা করে, তাতে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের বিলুপ্ত হওয়া ১৬(২) ধারা প্রয়োগ করা হয়। তারা বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। এর মধ্যে আশুলিয়া উপজেলার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মিনি আক্তার কাশিমপুরে এবং বাকি ১৪ জন কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। ১৫ জনের আটজনকে আলোচনার জন্য ২১ ডিসেম্বর আশুলিয়া থানার ওসি ডেকে নেন এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনের বিলুপ্ত ধারায় তাদের গ্রেফতার করেন। বাকি সাতজনকে পরে গ্রেফতার করা হয়। বাতিল ধারায় গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানোয় এরই মধ্যে গ্রেফতারকে চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে একটি রিটও হয়েছে। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৬(২) ও ২৫(ঘ)-এর অধীনে ওই শ্রমিকনেতাদের গ্রেফতার দেখানো হয়। ১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ একটি অধ্যাদেশ দিয়ে চুয়াত্তর সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৬, ১৭ ও ১৮ ধারা বাতিল করেন। বিএনপি তা ১৯৯১ সালের সংসদে পাস করেছিল। এরপর ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার মধ্যে ‘ক্ষতিকর ও ধ্বংসাত্মক’ (প্রধানত সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী) কাজ থেকে বিরত রাখতে ১৬ ধারাটি পুনরুজ্জীবিত করা হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর এই অধ্যাদেশসহ ১২২টি অধ্যাদেশ সংসদের প্রথম অধিবেশনে পেশ করা হয়, কিন্তু তা পাস হয়নি। ফলে বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৬, ১৭ ও ১৮ ধারা বাতিল অবস্থায় থেকে যায়। জানা গেছে, শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনায় একাধিক মামলায় মোট ২৭ জন জেলে আছেন। এর মধ্যে বিশেষ ক্ষমতা আইনের বিলুপ্ত বিধানের আওতায় কারাগারে আছেন ১৫ জন। এদের মধ্যে আহমেদ জীবন ও মিনি আক্তার ছাড়া অন্যরা হলেন সৌমিত্র কুমার দাস, রফিকুল ইসলাম সুজন, আল কামরান, সাকিল আহমেদ মোবারক, মিজানুর রহমান মিজান, মো. শামীম খান, মো. ইব্রাহীম, জাহাঙ্গীর আলম, এ আর মিন্টু, মো. তোফাজ্জল, আমিনুল ইসলাম, ইসরাফিল হোসেন ও দুলাল মীর।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর