শুক্রবার, ২০ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ

নওগাঁ প্রতিনিধি

ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ

নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার আত্রাই নদীতে ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ করে লাভের স্বপ্ন দেখছেন চাষিরা। এলাকায় মাছের চাষের নতুন এ পদ্ধতি দেখে স্থানীয় বেকার যুবক ও ভূমিহীন মত্স্যজীবীরা এখানে ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। উপজেলা মত্স্য কর্মকর্তার কার্যালয় ও স্থানীয় মাছ চাষিদের সূত্রে জানা যায়, মহাদেবপুরের মহিষবাথান ও কুঞ্জবন এলাকায় আত্রাই নদীতে ৭৬টি খাঁচায় মাছ চাষ করেছেন ৩৫ জন চাষি। নদীতে ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষে স্থানীয় লোকজনকে উদ্বুদ্ধ করতে গত বছর জুন মাসে উপজেলার মহিষবাথান গ্রামের ২০ জন মত্স্যজীবীকে নিয়ে একটি দল গঠন করে দেওয়া হয়। দলটিকে ১০টি খাঁচায় মাছ চাষের জন্য উপজেলা মত্স্য কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে দুই লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়। সেপ্টেম্বরে ওই সব খাঁচায় মনোসেক্স জাতের তেলাপিয়ার পোনা ছাড়া হয়। পরে নতুন পদ্ধতি দেখে স্থানীয় বেকার যুবকরা নিজস্ব উদ্যোগে নদীতে ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ শুরু করেন। পোনা ছাড়ার তিন মাস পর মাছের ওজন ও কোনো রোগবালাই দেখা না দেওয়ায় প্রতিটি খাঁচায় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা লাভের আশা করছেন চাষিরা।

এদেরই একজন মহিষবাথান গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি মহিষবাথান মত্স্যজীবী সমিতির সদস্য। তার কোনো জলাভূমি নেই। নদীতে মাছ ধরে ও মৌসুমের সময় অন্যের জমিতে কামলার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয় তাকে। তিনি বলেন, ছয়-সাত মাস আগে একদিন উপজেলা সহকারী মত্স্য কর্মকর্তা মাহফুজুল হক মহিষবাথানে এসে ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষের জন্য ২০ জনের একটি দল গঠন করতে বলেন। দল গঠন করার পর তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ১০টি খাঁচা তৈরি ও পোনা ছাড়ার জন্য দুই লাখ টাকা সরকারি অনুদানও দেওয়া হয়। অনুদানের টাকায় ড্রাম, নেট ও বাঁশ দিয়ে মহিষবাথান খেয়াঘাট এলাকায় আত্রাই নদীর ওপর ১০টি খাঁচা তৈরি করেন তারা। সেপ্টেম্বরে বগুড়ার আদমদীঘি থেকে মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছের পোনা এনে তারা খাঁচায় চাষ শুরু করেন। পরে ওই দলের সদস্যরা নিজেদের খরচে আরও ১০টি খাঁচা তৈরি করে ওই বছরের অক্টোবরে মাছের পোনা ছাড়েন। প্রতিটি মাছের ওজন ৯০০ থেকে ১ হাজার গ্রাম পর্যন্ত হয়েছে। কিছুদিন আগে পাঁচটি খাঁচা থেকে ৭৫ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করেছেন তারা। উদ্বুদ্ধ হয়ে মহিষবাথান খেয়াঘাট এলাকায় আত্রাই নদীতে খাঁচায় মাছ চাষ করছেন দুই বন্ধু মনজেল হোসেন ও বুলবুল আহমেদ। তারা দুজন মিলে তিন মাস ধরে ১৫টি খাঁচায় মাছ চাষ করছেন। তারা জানান, জিআই পাইপ, নেট ও ড্রাম দিয়ে ১০টি খাঁচা তৈরি করতে তাদের খরচ পড়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। আর বাঁশ, নেট ও  ড্রাম দিয়ে পাঁচটি খাঁচা তৈরিতে খরচ হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। হ্যাচারি থেকে পোনা এনে রাখার জন্য বাঁশ ও নেট দিয়ে একটি বড় হাঁফা (খাঁচা) তৈরি করতে খরচ হয়েছে ২০ হাজার টাকা। প্রতিটি খাঁচায় ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০টি করে ১৪টি খাঁচায় প্রায় ১৫ হাজার তেলাপিয়া মাছ ছেড়েছেন তারা। আর একটি খাঁচায় পরীক্ষামূলকভাবে পাঙ্গাশ চাষ করছেন। পোনা ছাড়তে খরচ পড়েছে ৯০ হাজার টাকা। মনজেল হোসেন বলেন, ‘ডিগ্রি পাস করে বাড়িতে বেকার বসে ছিলাম। নদীতে খাঁচায় মাছ চাষের পদ্ধতি দেখে আমি ও আমার বন্ধু বুলবুল খাঁচায় মাছ চাষ করার সিদ্ধান্ত নিই। পরে প্রশিক্ষণ নিয়ে মাছ চাষ শুরু করি। গত বছর অক্টোবরের মাঝামাঝি খাঁচায় মাছ ছাড়ার পর মাত্র আড়াই মাসে প্রতিটি মাছের ওজন ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম হয়েছে। আর ১৫-১৬ দিন পর মাছ বিক্রি করা যাবে। খাবারের খরচ বাদ দিয়ে আশা করা হচ্ছে প্রতিটি খাঁচার মাছ বিক্রি করে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা লাভ হবে। মাছ চাষি নওশাদ আলী বলেন, পাঁচ জলার মাছ মাত্র ১০টি খাঁচাতেই চাষ করা যায়। যাদের মাছের চাষের জন্য জলা নেই, তাদের জন্য এ পদ্ধতি খুবই উপকারী। পুকুরে বা যে কোনো বদ্ধ জলাশয়ে যে হারে মাছ বাড়ে, তার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি হারে নদীতে মাছ বাড়ে। নদীর পানিতে মাছের রোগবালাই হয় না বললেই চলে। মহিষবাথান সিবিজি (কমিউনিটি বেইসড গ্রুপ) দলের নেতা জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, সরকারি উদ্যোগে আরও বেশিসংখ্যক চাষিকে প্রশিক্ষণ ও বেকার যুবকদের স্বল্পমূল্যে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করলে এ পদ্ধতি আরও প্রসার লাভ করবে। এতে এলাকার বেকার যুবকরা স্বাবলম্বী হতে পারবে। মহাদেবপুর উপজেলা সহকারী মত্স্য কর্মকর্তা মাহফুজুল হক বলেন, ‘বেকার সমস্যা দূর ও ভূমিহীন মত্স্যজীবীদের স্বাবলম্বী করার উদ্দেশ্যে মহাদেবপুরে খাঁচায় মাছ চাষ শুরু হয়েছে। এলাকার মানুষজনের মধ্যে এ পদ্ধতি অল্প কিছুদিনের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। সিবিজি প্রকল্প দেখে অনেকে এ পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে আমাদের কাছে আসছে। প্রশিক্ষণ নিতে চাইছে। আমরাও তাদের সর্বাত্মক সহায়তা করছি।’

তিনি বলেন, স্বল্প পুঁজি নিয়েই এ পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা যায়। ২০ বাই ১০ ফুটের প্রতিটি খাঁচা তৈরিতে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়। আর টাকা খরচ হবে মাছের পোনা ও খাবার বাবদ। এর জন্য নিজস্ব কোনো জলাভূমির প্রয়োজন নেই। যে কেউ এ পদ্ধতিতে নদীতে মাছ চাষ করতে পারে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর