মঙ্গলবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

টেঁটাযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত নরসিংদী

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্ ও সঞ্জিত সাহা, রায়পুরা (নরসিংদী) থেকে

টেঁটাযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত নরসিংদী

রাজধানী ঢাকার পাশেরই একটি জনপদ নরসিংদী। মাঝে-মধ্যেই জেলাটি বর্বর এক সংঘাতের খবরের শিরোনাম হচ্ছে। ইদানীং এই সংঘাত বেশিই হচ্ছে। জেলার প্রত্যন্ত কিছু অংশে প্রতিনিয়ত ঘটছে খুন-খারাবি। ঘটছে বংশে বংশে হানাহানি, রাহাজানি, মারামারি। একটু কিছু হলেই শুরু হয় খোলা মাঠে সম্মুখ-যুদ্ধ। কার পক্ষকে পরাজিত করে কে জয়ী হবে—এমন মনোবাসনায় লিপ্ত এখানকার চরাঞ্চলের সাধারণ মানুষ। চরাঞ্চলের মানুষের মধ্যে পান থেকে চুন খসলেই বেধে যায় ঝগড়া-সংঘর্ষ। এলাকায় এলাকায় আওয়াজ দিয়ে বা মাইকিং করে দিন-ক্ষণ ঠিক করে টেঁটা-বল্লম-দা ঢাল নিয়ে মরণযুুদ্ধে একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর এসব সংঘর্ষে যোগ দিতে আশপাশের ২০-২৫ গ্রাম তো বটেই, দেখা গেছে বিশ-ত্রিশ মাইল দূর থেকেও আত্মীয়স্বজন আর জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর লোকজন এসে হাজির হন। কখনো কখনো পরপর দুই-তিন দিন ধরে চলে সংঘর্ষ। আর এসব বন্ধে নেই কোনো প্রশাসনিক তত্পরতা বা নতুন কোনো উদ্যোগ।

একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এই মরণখেলা বন্ধে পদক্ষেপ নেন না। অথচ প্রতিপক্ষের হামলা-মামলায় সর্বস্ব হারায় শত শত পরিবার। তবু তারা সর্বনাশা টেঁটাযুদ্ধ থেকে সরে দাঁডায় না। যারা নিহত হন, তাদের রক্তের প্রতিশোধ নিতে পাল্টা খুন আর মামলা চলে। সংঘর্ষ অনেকটা যেন স্থানীয়দের নেশায় পরিণত হয়েছে। চরের ৯৫ ভাগ পরিবারের সবাই টেঁটাযুদ্ধে সরাসরি জড়িত। আর এই মরণখেলায় শুধু পুরুষই নন; কোমলমতি ছোট্ট শিশু ও নারীরাও থাকেন সম্মুখ সারিতে। আর এই মরণযুদ্ধে জয়ী দল পরাজিত দলের বাড়ি-ঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। মালামাল লুট করে, আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। আর এই প্রতিহিংসা যেন এখানেই শেষ হয় না। পরাজিত পক্ষ দূরে থেকে নিজেরা আবারও দল শক্তিশালী করে এলাকায় এসে আবার সংঘর্ষে জড়ায়। এই সংঘর্ষ বন্ধ না করে সমাজের একশ্রেণির মুখোশধারী সমাজপতি দুপক্ষকেই পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করে। এমনকি দুই গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধিয়ে দুপক্ষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়। জানা গেল, অনেকেই এই নির্মম টেঁটাযুদ্ধ থেকে বাঁচতে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। যারা থাকছেন এই নির্মমতাকে নিয়তি হিসেবেই মেনে নিয়েছেন। নরসিংদীর চরাঞ্চলীয় ইউনিয়ন নিলক্ষা, হরিপুর, দড়িগাঁও, বাঁশগাড়ী, আলোকবালী, খুদাদিলাসহ কয়েকটি এলাকার চিত্রটা এমনই। তবে এক সময়ে অবহেলিত চরাঞ্চল এখন অনেকটা উন্নত হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা, বৈদ্যুতিক সুবিধাসহ রয়েছে নানা সুযোগ-সুবিধা। এতসব সুবিধা থাকার পরও পাল্টেনি তাদের আগের ‘চর দখলের’ চরিত্র। কৃষি ও প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ এই অঞ্চলের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। নিলক্ষা ইউনিয়নের সাতটি গ্রামের ছয় হাজারেরও বেশি মানুষ প্রবাসী। কিন্তু এই জনপদের এগিয়ে চলার বড় বাধা যুগ যুগ ধরে চলে আসা টেঁটাযুদ্ধ। কী কারণে চলছে এই টেঁটাযুদ্ধ? নেপথ্যের কারণ কী এই প্রশ্ন এখন সাধারণ মানুষের। টেঁটাযুদ্ধের নেপথ্যের কারণ খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেল গোষ্ঠীগত দাঙ্গা ও আধিপত্য বিস্তারের ইতিহাস। অভিযোগ রয়েছে, টেঁটাযুদ্ধের খবর পেয়ে থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে এলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয় না। এলাকাবাসী জানালেন, মরণখেলা এই টেঁটাযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন তৃণমূল থেকে জেলার রাজনৈতিক ও প্রভাশালী ব্যক্তিরাও। তারাই বন্ধ হতে দেন না এই সিরিজ লড়াই। এর সঙ্গে জড়িত আছে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও। থানা পুলিশ, মামলা, হামলা, গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে হাতিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা। আর এসব টাকার ভাগ-বাটোয়ারা পায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিএনপির নেতারাও। নিলক্ষা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, জেলা শহর থেকে নিলক্ষার দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার। গ্রামের ভিতরের পরিবেশ দেখলে কেউ বুঝবেনই না যে, এত সুন্দর একটি গ্রামের মানুষ মরণনেশা টেঁটাযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত। চারদিকে খোলা মাঠ, সবুজে আচ্ছাদিত ছোট-বড় গাছগাছালি। রয়েছে কয়েকটি স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা। তবে গ্রামের কয়েকটি স্থানে পুলিশকে পাহারা দিতে দেখা গেছে। কিন্তু ছক্কার মোড় নামক এলাকায় গিয়ে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। ছক্কার মোড় যার নামে, সেই ছক্কা মিয়া নিজেই গ্রাম ছেড়েছেন টেঁটাযুদ্ধের কারণে। চোখের সামনে একের পর এক মৃত্যু দেখে মেনে নিতে পারেননি তিনি। শুধু ছক্কা মিয়াই নন, চরাঞ্চলের এমন বহু বাসিন্দা এখন এলাকা ছেড়ে নরসিংদী শহরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বসতি গড়েছেন। একটু সামনে এগিয়েই দেখা মিলল, টেঁটাযুদ্ধের নির্মমতার চিত্র। দেখে গা শিউরে উঠল। অনেকটা প্রাগৈতাহিসক যুগের মতো একের পর এক বাড়ি-ঘর ভেঙে, লুটপাট চালিয়ে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফেলুমিয়া নামের এক ব্যক্তি প্রতিপক্ষের সঙ্গে টেঁটাযুদ্ধে হেরে যান। পরে তার দলবলসহ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান অন্যত্র। জয়ী হওয়া প্রতিপক্ষ ফেলুমিয়াকে না পেয়ে বাড়ির ছোটবড় ১৫টি পাকা ঘর ভেঙে, লুটপাট করে আগুন লাগিয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, পাশের জাকির মিয়ার চারটি পাকা বিল্ডিং, নজালি মেম্বারের পাঁচটি, অজালি মিয়ার তিনটি, আরবআলীর দুটি, হানিফার চারটি, বাছেদ মিয়ার তিনটি, ফুলমিয়ার দুটি, সাগর মিয়ার তিনটি, সানু পাগলার দুটি, সনুফ আলীর একটি, বসকু নেতার তিনটি, মোনতার দুটি, সামসুর দুটি, খাজার তিনটিসহ অন্তত ২৫ জনের পাকাবাড়ি ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। ষাটোর্ধ্ব বজলুর রশিদ জানালেন, ‘আমার ছয় সন্তান। একটু বড় হওয়ার পরই এলাকায় থাকতে দেইনি। তাদের নানার বাড়ি শিবপুরে রেখে বড় করেছি। পরে ৫ ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে দেই। আর একমাত্র মেয়েটি বিয়ে দিয়ে শুধু আমি একা থাকি গ্রামের এই বাড়িতে। জামাল নামের এক টেঁটাযোদ্ধা বললেন, আমরা এই মরণযুদ্ধে না গেলে হয় বেশি সমস্যা। দিতে হয় মোটা অঙ্কের চাঁদা। আর সংঘর্ষে আহত হলে নেতারা টাকা দিয়ে চিকিৎসা করান। কিন্তু মারা গেলে পরিবারকে ৪-৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়। মিনু ফকির নামের আরেক টেঁটাযোদ্ধা বলেন, হানাহানি সংঘাতের কারণে এলাকার সাধারণ মানুষ কোনোভাবেই শিক্ষায় এগুতে পারছে না। পরিবারের ছেলে সন্তানকে কোনোমতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বিদেশে। আর মেয়ে সন্তানটি অল্প বয়সেই বিয়ে দেওয়া হয়। দুপক্ষের মারামারির সময় কখনো নীরব দর্শক হয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় পুলিশকে। কখনো কখনো তো এমন হয়, পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা দুপক্ষের মাঝখানে আটকা পড়ে কোনোমতে মাথা নিচু করে, মাটিতে শুয়ে পড়ে জীবন বাঁচায়। এলাকাবাসী জানায়, শত বছর ধরে রায়পুরার চরাঞ্চলে চলছে এই টেঁটাযুদ্ধ। আর এই টেঁটাযুদ্ধ নিয়ন্ত্রণ করে দুটি পক্ষ। একটি পক্ষ নিয়ন্ত্রণ করেন সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হক সরকার। বাহিনীর সর্দার হলো সহি মেম্বার ও সোমেদ আলী। সহি মেম্বার ও সোমেদ আলী দুজনের পক্ষে রয়েছে গ্রামের কয়েক হাজার টেঁটাযোদ্ধা। তবে এখন আরও একটি পক্ষ নতুন করে সংঘবদ্ধ হয়েছে বলে জানায় এলাকাবাসী। আর এই নতুন পক্ষটি নিয়ন্ত্রণ করেন আওয়ামী লীগ নেতা রাজীব আহমেদ। তিনি আওয়ামী লীগের বড় এক নেতার আস্থাভাজন। অভিযোগ রয়েছে, এই রাজীব আহমেদই এলাকায় টেঁটার পাশাপাশি আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ সংযোজন করেছেন। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া চারটি হত্যা মামলার আসামি তিনি। টেঁটাযুদ্ধের এক পর্যায়ে টেঁটা-বল্লমের মজুদ শেষ হয়ে যায়। তখন ধীরে ধীরে স্থিমিত হয়ে আসে লড়াই। এ সময় ওই খোলা মাঠে অর্থাৎ যুদ্ধের ময়দানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায় উভয় পক্ষের টেঁটাবিদ্ধ নিহত ও আহতদের। মারাত্মক আহত আর মুমূর্ষুদের আর্তচিৎকারে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে একেকটি সংঘর্ষের ঘটনার পর। এরপর চলে মামলা-পাল্টা মামলার হিসাব-নিকাশ। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে সহস্রাধিক লোকের নামে থানায় হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। পরে মামলা সূত্রে এলাকায় মহড়া দেয় পুলিশ। আসামি আর তাদের স্বজনরা গ্রেফতার ও পুলিশি হয়রানির ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। এ সুযোগে একটি পক্ষের লোকজন আসামিদের বাড়িঘর, গরু-ছাগল, নৌকা ও জমির ধানসহ অন্যান্য জিনিসপত্র লুট করে পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। আর এসব ঘটনায় বছর খানেক স্থানীয় নেতা ও প্রভাবশালীদের কাছে নানাভাবে দেন-দরবার করে খুন প্রতি ১৫-২০ লাখ টাকা জরিমানা দিয়ে ‘সেটিং’ করে প্রতিপক্ষের বশ্যতা মেনে এলাকায় ফিরে আসে বিবাদী পক্ষ। নরসিংদীর রায়পুরা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আজহারুল ইসলাম সরকার দাবি করেন, আটটি চর ইউনিয়নসহ ২৪টি ইউনিয়ন রয়েছে রায়পুরায়। এর মধ্যে একটি পৌরসভাও আছে। একমাত্র নিলক্ষা ইউনিয়নেই এসব দাঙ্গা-হাঙ্গামা হচ্ছে। সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হক সরকার বলেন, ‘আমি পরাজিত হওয়ায় প্রতিপক্ষ আমার লোকজনের ওপর হামলা চালিয়ে বাড়ি-ঘর ভেঙে আগুন দেয়।’

সর্বশেষ খবর