শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা
কৃষি সংবাদ

বরেন্দ্র মাটিতে ফুল বিপ্লব

কাজী শাহেদ, রাজশাহী

বরেন্দ্র মাটিতে ফুল বিপ্লব

রাজশাহীর বরেন্দ্র মাঠ এখন এমনিতেই নানা ফসলের কারণে সবুজের সমারোহ। কোথাও হলুদ শর্ষে খেত, আবার কোথাও আলু, সবজি ও ধানে সবুজ উঁচু-নিচু প্রান্তর। চোখজুড়ানো এমন প্রকৃতির মাঝে আছে নানা রঙের ফুলের খেলা। ধান, আলু, সবজি, সরিষার পাশাপাশি তপ্ত এ মাটিতে এখন চাষ হচ্ছে হরেক ফুলের। দেশীয় গাঁদা, গোলাপের পাশাপাশি বরেন্দ্রর শক্ত এঁটেল মাটিতেও এখন চাষ হচ্ছে বিদেশি জারবেরা আর গ্লাডিওলাস। বাহারি ফুল চাষে সাফল্যও পেয়েছেন অনেকে। যে জমিতে একসময় বছরে মাত্র একবার ধান ছাড়া কোনো ফসলই চিন্তা করা যেত না, এখন সেই জমিতে ফলছে নানা জাতের ফসলের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি ফুল। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে ফুল চাষ করেই লালে লাল হয়েছেন এলাকার অনেকে। আবার অনেকে সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়েছেন শুধু ফুল চাষ করে। একজনের দেখাদেখি এ এলাকার আরও কিছু যুবক ও সাধারণ চাষি ফুল চাষের প্রতি আগ্রহী হয়েছেন। ফুল চাষ করে সাফল্যের দিশা খুঁজে পেয়েছেন রাজশাহীর গোদাগাড়ীর এমনই এক দম্পতি। গোদাগাড়ী উপজেলার সোনাদীঘি গ্রামের কাইয়ুম ও তার স্ত্রী নাদিরা বেগম মিলে প্রথমে ২০০৭ সালে মাত্র তিন কাঠা জমিতে গ্লাডিওলাস ফুলের চাষ শুরু করেন। সেখান থেকে লাভ হওয়ায় তিনি পরবর্তী সময়ে এক বিঘা জমি ইজারা নিয়ে ফুলের চাষ করেন। কয়েক বছরের ব্যবধানে এ দম্পতি এলাকায় পরিচিতি পেয়েছেন ফুলচাষি পরিবার হিসেবে। দেশের অন্যান্য অঞ্চল, বিশেষ করে যশোরের মতো রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে ফুল চাষে বিপ্লব ঘটেছে। কৃষকরা ধান, সবজি, গমের পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে গ্লাডিওলাস, চন্দ্রমল্লিকা, জারবেরা, গোলাপ, রজনীগন্ধা, গাঁদাসহ বিভিন্ন ফুল চাষ করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।

ফলে এ অঞ্চলে প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে ফুল চাষ। ফুলচাষিরা জানান, বরেন্দ্র অঞ্চলের ফুল রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, বগুড়া, নাটোরের বাজারে বিক্রি ছাড়াও বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার কাদিপুর গ্রামের প্রান্তিক চাষি কাইউম আলী তিন বছর ফুল চাষ করে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। চলতি বছর এক বিঘা জমিতে গ্লাডিওলাস চাষে খরচ হয়েছে ৪০ হাজার টাকা। এখন পর্যন্ত ৩০ হাজার টাকার ফুল বিক্রি করেছেন। আরও ১ লাখ ২০ হাজার টাকার ফুল বিক্রি হবে তার। ফুলচাষি কাইউম আলী বলেন, ধান, গম, শাক-সবজি চাষ করে খুব একটা লাভবান হতে পারেননি তিনি। তবে স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলামের পরামর্শে রবি ফসল হিসেবে প্রথমে ১৫ কাঠা জমিতে গ্লাডিওলাস, গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা ও রজনীগন্ধা ফুলের চাষ করেন। প্রথম বছর ফুল চাষ করে ৭০ হাজার টাকা লাভ হওয়ায় প্রতি বছর ধান, গমের পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ করে আসছেন কাইউম। পাইকাররা জমি থেকেই তার উৎপাদিত ফুল কিনে নিয়ে যান। উপজেলার সোনাদীঘি গ্রামের মোশারফ হোসেন ১৫ কাঠা জমিতে ফুল চাষ করে গত বছর ১ লাখ ১০ হাজার টাকা লাভ করেন। আর বগদামারী গ্রামের শেখ ফরিদ পাঁচ কাঠা জমিতে ফুল চাষ করে সাফল্য পাওয়ায় এবারও ফুল চাষ করেছেন। উপজেলার বিদিরপুর ব্লকে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম বলেন, এ অঞ্চলের কৃষকরা ধান, গম ছাড়া অন্য ফসল চাষে আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু কিছু আগ্রহী কৃষককে অর্থকরি ফসল চাষের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ফুল চাষের জন্য কয়েকজন চাষিকে যশোরের ঝিকরগাছায় ফুল চাষ পরিদর্শন করানো হয়। এরপর মাঠপর্যায়ের কৃষি বিভাগের কারিগরি সহায়তায় ফুল চাষ করে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন এ অঞ্চলের কৃষকরা।

উপজেলার বাউটিয়া গ্রামের আফজাল হোসেন কৃষিতে ডিপ্লোমা করার পর সরকারি চাকরি না পেয়ে কৃষিকাজে নেমে পড়েন। চলতি রবি মৌসুমে ১৫ কাঠা জমিতে গ্লাডিওলাস ও জারবেরা ফুলের চাষ করে অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছেন। আগামী বছর আরও বেশি জমিতে ফুল চাষের পাশাপাশি বিভিন্ন অর্থকরি ফসল চাষের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন এই কৃষক। বাউটিয়া গ্রামে তিন বছর ধরে জাপানের একটি সংস্থা স্থানীয় কৃষকদের নিয়ে জারবেরা, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা ও দেশি গাঁদা ফুলের চাষ করছেন আধুনিক প্রযুক্তিতে। এ গ্রামের কৃষক মুখলেসুর রহমান মুকুল বলেন, এ গ্রামে উৎপাদিত ফুল রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাজারে সরবরাহের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ ফুল জাপানে রপ্তানি হচ্ছে।

বরেন্দ্র অঞ্চলে এখন ডালিয়া, জিনিয়া, জিনিয়া গাঁদা, চায়না গাঁদা, ক্যাম্বেলুনা, সিলভিয়া, মোরগজটা, হাসনাহেনা, রজনীগন্ধা, গোলাপ ছাড়াও গ্লাডিওলাস ফুলের চাষ হচ্ছে। আর গাঁদা ফুলের চাষ তো রয়েছেই। এসব চাষে জমে উঠেছে শীতকালীন ফুলের কারবার। মৌসুমজুড়ে কয়েক কোটি টাকার বাণিজ্যের প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাণিজ্যিকভাবে গাঁদা ফুল চাষে নেমেছেন জেলার পবা উপজেলার দামকুড়ার হরিষার ডাইং এলাকার জাফর ইকবাল। তিনি পরীক্ষামূলকভাবে এক বিঘা জমিতে হলুদ গাঁদা ফুলের চারা রোপণ করেছেন। যথারীতি বাগান থেকে ফুল বিক্রি শুরু করেছেন তিনি। এবারের বিজয় দিবসে ফুল ব্যবসায়ীরা তার বাগান থেকে ৬০ হাজার টাকার ফুলের অর্ডার দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘অন্যান্য ফসলের তুলনায় ফুল চাষে খরচ কম। রোগবালাই নেই বললেই চলে। জমি প্রস্তুতের পরে চারা রোপণ করতে হয়। এক বিঘা জমিতে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। উৎপাদন ভালো হলে লাখ টাকায় বিক্রি হবে বলে আশা করছি।’ তিনি বলেন, তার ফুল চাষে প্রথমে অনেকে হাসাহাসি করেছেন। কিন্তু এখন অনেকে ফুল চাষ করার জন্য তার কাছে পরামর্শ নিচ্ছেন। এতে তিনি উৎসাহিত হচ্ছেন বলেও জানান।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, শীতকালীন ফুলের মধ্যে গাঁদা অন্যতম। সাধারণত এটি শীতকালীন ফুল হলেও বর্তমানে গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে এর চাষাবাদ হয়। গাঁদা ফুলের আছে নানা ঔষধি গুণ।

এদিকে ফুলচাষিদের চাহিদার কথা ভেবে রাজশাহীতে অ্যাগ্রোব্যাক নামের একটি টিস্যু কালচার ল্যাব বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের চারা উৎপাদন করেছে। দেশের ফুলচাষিদের আশার আলো জুগিয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি। জেলার দুর্গাপুর উপজেলায় অ্যাগ্রোব্যাক ল্যাবে টিস্যু কালচারের মাধ্যমে জারবেরা, ইউস্টোমা, লিলিয়াম, টিউলিপ, চন্দ্রমল্লিকাসহ বিভিন্ন ফুলের চারা উৎপাদিত হেচ্ছ। কৃষকদের মধ্যে সেগুলো সরবরাহ শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, সারা দেশে টিস্যু কালচারের ফুলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ভারত থেকে তারা কোটি কোটি টাকার চারা কেনেন। এখন দেশে এই প্রতিষ্ঠান যেভাবে বিভিন্ন ফুলের চারা উৎপাদন শুরু করেছে, তাতে ভবিষ্যতে আর ভারত থেকে চারা আনতে হবে না। এতে দেশের ফুলচাষিরা লাভবান হবেন।

রাজশাহীতে টিস্যু কালচার ল্যাবের উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও পরিচালক মতিউর রহমান বলেন, ‘আমরা টিস্যু কালচারের মাধ্যমে জারবেরা, ইউস্টোমা, লিলিয়াম, টিউলিপ, চন্দ্রমল্লিকাসহ বিভিন্ন ফুলের চারা উৎপাদন করেছি। কৃষকদের মধ্যে সেগুলো সরবরাহ করা হচ্ছে।’

গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তৌফিকুর রহমান বলেন, ফুল চাষের জন্য এ অঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়া অত্যন্ত উপযোগী। উঁচু জমিতে ফুল চাষ ভালো হওয়ায় এ অঞ্চলের কৃষকরা ফুল চাষে ঝুঁকছেন। আগ্রহী কৃষকদের ফুল চাষের ওপর প্রশিক্ষণ দিচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর।

রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাবে, রাজশাহী অঞ্চলে এ বছর বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ হচ্ছে প্রায় ২০ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে রাজশাহীতে ৯ দশমিক ৬ হেক্টর, নওগাঁয় ৩ দশমিক ৩৬ হেক্টর ও নাটোরে ৮ হেক্টর। গত বছরের চেয়ে এ বছর বেড়েছে ফুল চাষ।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর