শনিবার, ২৮ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

অচল মেশিন, চিকিৎসক সংকট ভোগান্তির শেষ নেই রোগীদের

মাহমুদ আজহার ও আবদুল লতিফ লিটু, ঠাকুরগাঁও থেকে

অচল মেশিন, চিকিৎসক সংকট ভোগান্তির শেষ নেই রোগীদের

সম্প্রতি হার্নিয়ার অপারেশন করাতে ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালে ভর্তি হন আবদুল খালেক। সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী সুলতানা আহমেদ। রোগীর স্ত্রীর সঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশ প্রতিদিনের। ক্ষোভের সঙ্গে তিনি জানালেন, ‘অপারেশনের জন্য চার দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আছি। আমার স্বামীর অবস্থা ভালো না। ব্যথায় আর টিকতে পারতেছে না। অপারেশনের কথা বললে চিকিৎসকরা বাইরের ক্লিনিকে নিয়ে যেতে বলেন। তাদের এখানে দেখা পাওয়াও কঠিন। সবাই ক্লিনিক নিয়ে ব্যস্ত। ক্লিনিকে চিকিৎসার মতো টাকা আমার নেই। এখন নিরুপায় হয়ে মনে হয় স্বামীর লাশ নিয়ে বাসায় যেতে হবে।’

এ চিত্র শুধু ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালেই নয়, জেলার আরও চারটি সরকারি হাসপাতালেও একই অবস্থা। সব হাসপাতালের অবস্থাই বেহাল। একে তো চিকিৎসক সংকট, এরপর আবার চিকিৎসকরা হাসপাতালে সময় দেন কম। তারা ব্যস্ত ক্লিনিক নিয়ে। এক্স-রে মেশিন কিংবা আলট্রাসোনোগ্রাফি মেশিন কোনোটিই নেই ঠাকুরগাঁওয়ের পাঁচটি সরকারি হাসপাতালে। মেশিন থাকলেও সচল নেই কোনোটিতে। হাসপাতালেই নেই বিশেষজ্ঞ কোনো চিকিৎসক। এমনকি প্রতিটি হাসপাতালেই নিয়মিত চিকিৎসক সংকট প্রকট। সরকারের দেওয়া বরাদ্দ অনুযায়ী রোগীরা পাচ্ছে না ওষুধসেবা। নোংরা পরিবেশে রোগীরা আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। যেসব চিকিৎসক রয়েছেন, তারা প্রাইভেট চিকিৎসায় বেশি মনোযোগী। হাসপাতালগুলোতে রিপ্রেজেনটেটিভের দৌরাত্ম্য তো আছেই। এ প্রসঙ্গে জেলার ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. আবু মো. খায়রুল কবির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জেলার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোয় চিকিৎসক-সংকটের কারণে মহাবিপদে রয়েছি। জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক চেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি পাঠিয়েছি। কিন্তু এখনো কোনো সুরাহা হয়নি।’ সরেজমিনে ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালে ঘুরে দেখা গেছে, হাসপাতালটিতে মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি, শিশু, অর্থোপেডিকস, ইএনটি, চক্ষু, দন্ত, প্যাথলজি ও রেডিওলজি বিভাগ রয়েছে। কিন্তু নেই কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। ১০০ শয্যার হাসপাতালে যেখানে ৪৪ জন চিকিৎসক থাকার কথা, সেখানে কর্মরত মাত্র আটজন। এর মধ্যে ছুটিতে আর প্রশিক্ষণে থাকেন অর্ধেকই। এখানে হৃদরোগের জন্য চিকিৎসকের কোনো পদ বরাদ্দ নেই। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার না থাকায় প্রতিনিয়ত এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। শুধু তা-ই নয়, নার্স ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর ১৮টি পদ শূন্য থাকায় রোগীর চাপ সামলাতে দিশাহারা কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, বেডের অভাবে মেঝে, বারান্দা ও সিঁড়ির ফাঁকে গাদাগাদি করে চিকিৎসা নিচ্ছেন  রোগীরা। হাসপাতালে ঠাকুরগাঁও ছাড়াও পাশের জেলা পঞ্চগড়, দিনাজপুর ও নীলফামারী থেকে প্রতিদিন অন্তত ৭০০-৮০০ রোগী চিকিৎসা নিতে আসছেন। এদের মধ্যে ভর্তি হচ্ছেন ২০০-৩০০ জন। গাদাগাদি অবস্থান আর দুর্গন্ধযুক্ত টয়লেটেও অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।

রোগীদের অভিযোগ, ডাক্তার, নার্স, বিছানা, ওষুধসহ কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না রোগীরা। সরকার বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহের কথা বললেও সদর হাসপাতালে প্যারাসিটামল, মেট্রিল আর স্যালাইন ছাড়া কোনো ওষুধ পাওয়া যায় না। প্রয়োজনীয় ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়। ঠাকুরগাঁও সদরের আঁকচা ইউনিয়ন থেকে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী সলেমান আলী বলেন, ‘হাসপাতালে কোনো ডাক্তার নেই। বেলা ১১টায় ডাক্তার এসে দেখে চলে যান। কোনো অসুবিধা হলে আর ডাক্তার খুঁজে পাওয়া যায় না। বাইরের ক্লিনিকগুলোতে গেলে আবার ডাক্তারের অভাব নেই।’ বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী শামসুল বলেন, ‘সকাল থেকে বসে আছি টিকিট নিয়ে। এখনো কোনো ডাক্তার আসে নাই। ১২টার পর ছাড়া ডাক্তার আসে না। আবার অনেক ডাক্তারের চেম্বার ফাঁকা হয়ে আছে। তারা নাকি নাই। এখন কোথায় যাব, আমরা গরিব মানুষ। আমাদের কি তাহলে চিকিৎসা ছাড়াই মরতে হবে!’

জরুরি প্রসূতিসেবায় রংপুর বিভাগে ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স দুবার প্রথম স্থান অর্জন করেছে। অথচ এ হাসপাতালেই চিকিৎসক সংকটে সেবা ব্যাহত হচ্ছে। ৫০ শয্যার এ হাসপাতালে ৩১ শয্যার জনবল-কাঠামো অনুযায়ী চিকিৎসকও নেই। নয়জনের জায়গায় মাত্র তিনজন চিকিৎসক সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান সহকারী মাইজুল হক জানান, ২০১০ সালের ১৪ অক্টোবর এ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। কিন্তু তিন বছর পরও ৫০ শয্যার কাঠামো অনুযায়ী চিকিৎসকসহ অন্যান্য পদে লোকবল নিয়োগ করা হয়নি। এখানে ৩১ শয্যার জনবল-কাঠামো অনুযায়ী নয়জন চিকিৎসক থাকার কথা। কিন্তু কর্মরত আছেন চারজন। ডাক্তার, নার্স ও প্রয়োজনীয় জনবল সংকটের কারণে ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা প্রায় ভেঙে পড়েছে। চিকিৎসাসেবা না পাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছে উপজেলার হতদরিদ্র মানুষ। হরিপুর উপজেলা একটি সীমান্তবর্তী অবহেলিত, উন্নয়নবঞ্চিত, দারিদ্র্যপীড়িত, মঙ্গা অঞ্চল। এ উপজেলায় দুই লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। এখানকার মানুষ আদি যুগ থেকে চিকিৎসাবঞ্চিত। হাতুড়ে ডাক্তার, ওঝা ও কবিরাজের ঝাড়ফুঁকের ওপর নির্ভর করে এ অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যসেবার মান। ৫০ শয্যার হাসপাতালে ইউএইচএফপিওসহ ২৭ জন ডাক্তার থাকার কথা। রয়েছে মাত্র ১১ জন। কাগজে-কলমে ১১ জন ডাক্তার থাকলেও ছয়জন ডেপুটেশনে অনত্র চলে গেছেন। ফলে কর্মরত আছেন পাঁচজন। এই পাঁচজন ডাক্তারের মধ্যে প্রতিদিন এক থেকে দুজন তাদের দায়িত্ব পালন করেন। নার্স সুপারভাইজারসহ ১৬ জন নার্সের কর্মস্থলে আছে মাত্র সাতজন। দায়িত্ব পালন করেন দুই থেকে তিনজন। পরিসংখ্যানবিদ, ফার্মাসিস্ট, ক্যাশিয়ার, ওয়ার্ডবয় ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী দীর্ঘদিন ধরে নেই। সংকটময় জনবল দিয়েই কোনোরকম দায়সারা চিকিৎসাসেবার কার্যক্রম চলছে। উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা থেকে। ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কেবিন, প্রসূতি ও শিশু ওয়ার্ডের অধিকাংশ জানালার কাচ ভাঙা। সারা রাত ওই সব জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস ভিতরে ঢোকে। এতে শীতে রোগীরা ভোগান্তির শিকার হয়। এ ছাড়া পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও জনবল সংকটে রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালটিতে মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি, শিশু, অর্থোপেডিকস, ইএনটি, চক্ষু, দন্ত, প্যাথলজি ও রেডিওলজি বিভাগ চালু থাকলেও গাইনি ও সার্জারির সিনিয়র কনসালটেন্ট নেই। নেই চক্ষু ও দন্ত কনসালটেন্ট। এ ছাড়া রেডিওলজিস্ট ও প্যাথলজিস্ট। এ ব্যাপারে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ইয়াকুব আলী মোড়ল বলেন, সীমান্ত উপজেলা হওয়ায় এখানে চিকিৎসকরা থাকতে চান না। তবু চিকিৎসাসেবার মান উন্নয়নে আরও চিকিৎসকের জন্য ওপর মহলে আবেদন করা হয়েছে। এ ছাড়া রানীশংকৈল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একই অবস্থা। এখানে ডাক্তার, নার্স ও জনবলের অভাবে রোগীদের সেবা দিতে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে।

সর্বশেষ খবর