রবিবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

বাড়তি বইয়ের বোঝায় ক্লান্ত শিশু শিক্ষার্থীরা

শিক্ষাজীবন যেভাবে হয় শুরু - ১

জিন্নাতুন নূর

বাড়তি বইয়ের বোঝায় ক্লান্ত শিশু শিক্ষার্থীরা

রাজধানীর মিরপুরে একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী জাইফ আবরার। এই ছোট্ট জাইফকে তৃতীয় শ্রেণিতেই পড়তে হচ্ছে মোট ১৩টি বই। এর মধ্যে শুধু ইংরেজি বিষয়ের জন্য তাকে সাহিত্য, গল্প ও ভাষা মিলিয়ে পাঁচটি বই এবং বাংলার জন্য দুটি বই পড়তে হচ্ছে। এ ছাড়াও জাইফকে অঙ্ক, সামাজিক বিজ্ঞান, নৈতিক শিক্ষা, বিজ্ঞান, কম্পিউটার শিক্ষা ও সৃজনশীল লেখনীর বিষয়গুলোও পড়তে হচ্ছে। জাইফের মা লুবনা রহমান জানান, দুপুরে স্কুল থেকে বাসায় ফিরেই স্কুলের হোমওয়ার্ক নিয়ে আবার বসে পড়তে হচ্ছে জাইফকে। এ জন্য প্রায়ই ক্লান্ত থাকে শিশুটি। মিরপুরের মনিপুর স্কুলের তিন নম্বর শাখায় ৭ম শ্রেণির ছাত্রী তাসনিম তাহের। বোর্ড নির্ধারিত মোট ১৩টি বই পড়তে হয় তাসনিমকে। বইগুলো হচ্ছে— বাংলা ১ম ও ২য় পত্র, ইংরেজি ১ম ও ২য় পত্র, গণিত, ধর্ম, সমাজ, বিজ্ঞান, শারীরিক শিক্ষা, কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা, গার্হস্থ্য বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং চারু ও কারু।

এই শিক্ষার্থী জানায়, ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে থাকাকালীন তাকে বোর্ড নির্ধারিত ১২টি বইয়ের পাশাপাশি আরও তিনটি সহায়ক বই (অক্সফোর্ড অ্যাডভেঞ্চার উইথ গ্রামার অ্যান্ড কম্পোজিশন, ক্রিয়েটিভ গ্রামার, বাংলা ভাষা শৈলী ও বাংলা ব্যাকরণ নির্মিতি) পড়তে হয়েছিল। তবে নতুন বছরের প্রথম মাস হওয়ায় তাসনিমের স্কুল থেকে এ পর্যন্ত কোনো সহায়ক বইয়ের লিস্ট দেওয়া হয়নি। তাসনিম বলে, ‘ভারী ব্যাগ বইতে গিয়ে আমার ঘাড়ে খুব ব্যথা করে। আমাকে প্রতিদিন ব্যাগে ১২টি বইখাতা নিয়ে স্কুলে যেতে হয়। আর আমার কষ্ট দেখে বাবাই এখন স্কুলব্যাগ বহন করেন।’ তাসনিমের বাবা আবু তাহের খোকন এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘স্কুলে পড়ানোর সময় সব বিষয়ের ওপর শিক্ষকরা সমান গুরুত্ব দেন না। এ কারণে ভালো ফলাফলের জন্য সন্তানকে কোচিংয়ে পাঠাতে হচ্ছে। সেখান থেকেও আবার গাইড কেনার কথা বলা হয়েছে। ফলে সন্তানের ওপর অতিরিক্ত মানসিক চাপ পড়ছে। এমনকি অত্যধিক চাপে শিশুটি ঠিকমতো বিশ্রামের সুযোগ পর্যন্ত পাচ্ছে না। মনোচিকিৎসক ডা. মোহিত কামাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অত্যধিক বইয়ের চাপে বাচ্চাদের ওপর ‘কনভারশন ডিসওর্ডার’ তৈরি করে। একটি সময় তারা হিস্টেরিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ ছাড়া নানারকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও দেখা দেয়। বাচ্চারা শ্বাসকষ্টসহ নানাবিধ শারীরিক ও মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, নিয়মানুযায়ী জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)-এর বইয়ের বাইরে দেশের স্কুলগুলোতে কোনো সহায়ক বইকে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ব্যবহার করার নিয়ম নেই। শিশুদের শ্রেণি অনুযায়ী বইয়ের তালিকা তৈরি করে দিয়েছে এনসিটিবি। এনসিটিবি আইন ১৯৮৩, ধারা (১৫.১) অনুযায়ী এর বাইরে বই পাঠ না করার জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু এনসিটিবির নির্ধারিত বইগুলোর চেয়ে স্কুলগুলোতে অতিরিক্ত পাঠ করানো হচ্ছে। কিন্ডারগার্টেনগুলোতে বোর্ড নির্ধারিত বইয়ের বাইরে অতিরিক্ত বই পড়ানোর হার সবচেয়ে বেশি। অভিভাবকদের অভিযোগ, কতিপয় প্রকাশনী সংস্থা থেকে নিয়মিত আর্থিক সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে দেশের বহু স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষক-শিক্ষিকারা শিক্ষার্থীদের এই সহায়ক বইগুলো পড়তে বাধ্য করছেন। এতে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ক্ষেত্রে অনীহা ও ভীতির উদ্রেক হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেআইনিভাবে শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত বই পাঠ্যবই পড়ানোয় তাদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপও বাড়ছে। শিক্ষার্থীরা না বুঝে, নিরুৎসাহিত হয়ে পড়া মুখস্ত করছে। সকালে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার পাঁচ থেকে ছয় বছর বয়সী শিশুদেরকে তাদের ওজনের চেয়েও ভারী ব্যাগ বহন করে স্কুলে যেতে দেখা যায়। অনেকের ব্যাগই হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ঝুলে থাকে। কিন্তু অভিভাবকরা সন্তানের এই কষ্ট দেখেও যেন নিরুপায়।  প্রাপ্ত অভিযোগ অনুযায়ী, শিশুদের স্কুলব্যাগ বহন নিয়ে আদালতের আদেশের গুরুতর লঙ্ঘন করে চলেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। শিশুদের কষ্টের কথা বিবেচনায় এনে বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করেন উচ্চ আদালত। গত বছরের ডিসেম্বরে আদালত জানিয়েছে যে, শিশুর ওজনের ১০ শতাংশের বেশি হবে না স্কুল ব্যাগ। এ ছাড়া সদ্য স্কুলে যাওয়া প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের কাঁধে-পিঠে কোনো ধরনের বইয়ের ব্যাগ চাপানোর ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা জারি করে আগামী ছয় মাসের মধ্যে সরকারকে এ সংক্রান্ত একটি আইন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আইন হওয়ার আগে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালকের এই মর্মে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করার কথা। আর বিষয়টি দেখার জন্য একটি তদারকি টিম গঠনের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর ২য় থেকে ৪র্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রবিশেষে ১০ থেকে ১৩টি পর্যন্ত বই পড়তে হচ্ছে। এমনকি কেজি শ্রেণির শিক্ষার্থীকেও বইতে হচ্ছে পাঁচটি বই। অথচ জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুসারে ২য় শ্রেণিতে তিনটি এবং ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণিতে সর্বোচ্চ ছয়টি বই পড়ানোর কথা। বাস্তবে এমনটি দেখা যাচ্ছে না। বোর্ড অনুমোদিত বিভিন্ন বইয়ের বাইরেও শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সহায়ক ইংরেজি বই, বাংলা ব্যাকরণ বই, আরবি বই পাঠ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। এমনকি কিন্ডারগার্টেনের বাইরেও রাজধানীর নামিদামি স্কুলগুলোতে বোর্ড নির্ধারিত বইয়ের বাইরে অতিরিক্ত বই পাঠ করতে দেওয়া হচ্ছে। মাধ্যমিক পর্যায়েও কোনো কোনো স্কুলে বোর্ড নির্ধারিত ১২টি বইয়ের পাশাপাশি ইংরেজি গ্রামার ও পাঁচ থেকে ছয়টি গাইড বই সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করানো হচ্ছে। এর বাইরে পেন্সিল বক্স, কালার বক্স, টিফিন বক্স মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের ব্যাগের ওজন আরও বেড়ে যাচ্ছে।  এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, বাংলদেশের কিছু বিদ্যালয়ে বেআইনিভাবে এনসিটিবির বইয়ের সঙ্গে অতিরিক্ত বই পড়তে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হচ্ছে, যার জন্য শিক্ষার্থীদের মাঝে মানসিক ভীতি তৈরি হচ্ছে। এ অবস্থায় তারা লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে।

সর্বশেষ খবর