শনিবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

কুয়েতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ছে বাংলাদেশিদের

শিমুল মাহমুদ, কুয়েত থেকে

আরব সাগরের কোল ঘেঁষে বিকশিত মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম ধনী দেশ কুয়েতে বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ছে। শ্রমিক নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা না উঠলেও বিশেষ অনুমতি নিয়ে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে দক্ষ পেশাজীবীদের কুয়েত যাওয়ার সুযোগ ক্রমান্বয়ে সৃষ্টি হচ্ছে।

উপসাগরীয় যুদ্ধের পর থেকে ২০০৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা উন্মুক্ত ছিল। তবে কিছু উচ্ছৃঙ্খল প্রবাসী বাংলাদেশির নানা অপরাধ এবং ভারতীয়দের বাংলাদেশি বিরোধী প্রচারণার কারণে মূলত বাংলাদেশের ভিসা বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৪ সালের শুরু থেকে বিশেষ সুপারিশমালায় বাংলাদেশিদের জন্য চিহ্নিত কিছু ক্যাটাগরিতে কাজ করার ভিসা পাওয়া যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন নামিদামি কোম্পানিতে কাজের চাহিদা বেড়েছে। ক্লিনিং কোম্পানি, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, নার্স, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষক, পাঁচতারকা হোটেলের সেফ, ওয়েটার, ওয়েট্রেস, ম্যানেজমেন্ট স্টাফ এবং সুপার মার্কেটে কাজ পাওয়া যেতে পারে। এসব স্থানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। আশার কথা হচ্ছে, গত বছর কুয়েতে যোগ দিয়েছেন উদ্যমী রাষ্ট্রদূত এস এম আবুল কালাম। কুয়েতের সরকারি প্রশাসনে তার যোগাযোগ ভালো। তিনি বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানের ব্যাপারে তৎপরতা চালাচ্ছেন। গত আগস্টে কুয়েতের আমিরের সঙ্গে সাক্ষাত্ করতে গেলে তিনি কুয়েতে বিদেশি শ্রমশক্তি আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার ঘোষণা দেন। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর হিসাবে, ১৯৭৬ থেকে ২০১৬ সালের মার্চ পর্যন্ত ৫ লাখ ৫ হাজার ৪৭ জন বাংলাদেশি গেছেন কুয়েতে। এর মধ্যে ১৯৭৬ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত গড়ে প্রতি বছর ১০ হাজার লোক কুয়েতে গেছেন। ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধে কুয়েতের পক্ষে অবস্থানের কারণে দেশটিতে বাংলাদেশের সুনাম বেড়ে যায়। এরপর ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত গড়ে ২৫ হাজার লোক দেশটিতে গেছেন। ২০০১ সালের পর তা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে এবং প্রতি বছর ৩০ থেকে ৪০ হাজার লোক কুয়েতে যেতে থাকেন। ২০০৭ সালে বাজারটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ২০০৮ সালে মাত্র ৩১৯ জন, ২০১০ সালে ৪৮ জন, ২০১১ সালে ২৯ জন, ২০১২ সালে মাত্র ২ জন ও ২০১৩ সালে ৬ জন কর্মী যান দেশটিতে। ২০১৪ সালের শেষ দিক থেকে আবারও কর্মী যাওয়া শুরু করে। গত বছর ১৭ হাজার ৪৭২ জন কর্মী গেছেন দেশটিতে। জনশক্তি রপ্তানিকারকরা বলছেন, কুয়েতের শ্রমবাজার চালু হলে বছরে ৫০ হাজারেরও বেশি কর্মীর কর্মসংস্থান হতে পারে।

মহিলা চালক বিপজ্জনক : কুয়েতের রাস্তায় বিশ্বের সব ধরনের দামি গাড়ির ছড়াছড়ি। কুয়েত সিটিতেও চার থেকে ৮ লেনের রাস্তা। গাড়ির গড় গতিসীমা ১০০ কিলোমিটার। ১৪০-১৬০ কিলোমিটারেও গাড়ি চলে ফাঁকা হাইওয়েতে। চালকদের অন্তত ৪০ ভাগ নারী। এই নারী চালকরা অত্যন্ত বিপজ্জনক। কুয়েতে বাংলাদেশ দূতাবাসের এক কর্মকর্তা বলেন, মহিলা চালকরা মোবাইল টিপে আর হাইস্পিডে গাড়ি চালায়। সামনে কিংবা ডানে-বাঁয়ে তাকানোর সুযোগ নেই তাদের। তিনি বলেন, গত বছর আমরা দূতাবাসের ব্যবস্থাপনায় প্রায় ২০০ জন প্রবাসীর লাশ দেশে পাঠিয়েছি। এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা সর্বাধিক। কুয়েত জুড়েই সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার বেশি।

নিজ দেশে সংখ্যালঘু কুয়েতিরা : অতিরিক্ত অভিবাসীর কারণে নিজ দেশেই সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছেন কুয়েতিরা। বর্তমানে কুয়েতের নাগরিক ১২ লাখ। অন্যদিকে দেশটিতে আসা অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যা ২৫ লাখ। কুয়েতে বসবাসকারী জনসংখ্যার মধ্যে বর্তমানে মাত্র ৩১.৩ ভাগ রয়েছেন কুয়েতি নাগরিক। মোট ৩৯ লাখ ৬৫ হাজার ২২ জনের মধ্যে কুয়েতির সংখ্যা ১২ লাখ ৪২ হাজার ৪৯০ জন। এ ছাড়া কুয়েতের প্রায় ২৫ লাখ অভিবাসীর মধ্যে ৩৭.৮ ভাগ নিয়ে ১৪ লাখ ৯৯ হাজার ৯৯৯ জন এশীয় অভিবাসী শ্রমিক। এর মধ্যে প্রায় আড়াই লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক রয়েছে দেশটিতে। দেশটিতে অভিবাসী আরব রয়েছেন ২৭.৯ ভাগ। কুয়েত প্রবাসী একাদিক ব্যবসায়ী বলেন, কুয়েত যেভাবে উন্নতি করেছে সেখানে অভিবাসী ছাড়া কোনোভাবেই চলতে পারবে না তারা। তাদের টোটাল সিস্টেম সচল রাখতেই বিপুলসংখ্যক অভিবাসী দরকার। এ জন্য কুয়েতের শ্রমবাজার সব সময়ই সচল থাকবে। সেটি আমরা কতটা নিজেদের জন্য নিতে পারি সেটাই মূল বিষয়। 

কুয়েত-বাংলাদেশ বাণিজ্য : বাংলাদেশ শুধু কুয়েতে শ্রমিক পাঠিয়েই বসে নেই, কুয়েতের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যেও বাংলাদেশের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারিত্ব। গত অর্থবছরেই বাংলাদেশ কুয়েত থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার তেল কিনেছে। গত বছর মে মাসে কুয়েতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে কুয়েত চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (কেসিসিআই) বাণিজ্য প্রতিনিধি দলও এফবিসিসিআইয়ের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেয়। এ সময় দুই দেশের ব্যবসায়ীরা দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য উন্নয়ন, প্রতিনিধি দল বিনিময় ও ব্যবসা  নেটওয়ার্ক বাড়াতে এফবিসিসিআই এবং কেসিসিআই একটি ‘সমঝোতা স্মারক’ স্বাক্ষর করে।

উল্লেখ্য, ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ কুয়েতে ১৭ দশমিক ১৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। কুয়েত থেকে ৮৫৯ দশমিক ৮৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। বাংলাদেশ কুয়েতে মূলত কৃষিজাত পণ্য, নিট ওয়্যার ও হিমায়িত খাদ্যসহ অন্যান্য পণ্য রপ্তানি করে থাকে। গত বছরের জুনে কুয়েতে ওষুধ রপ্তানি শুরু করেছে বেক্সিমকো ফার্মা। জানা গেছে, দেশের বাজারের চেয়ে অন্তত ২৫ শতাংশ বেশি দামে কুয়েতের বাজারে ওষুধ রপ্তানি করা যাচ্ছে এবং কুয়েত অন্য যেসব দেশ থেকে আমদানি করে সে তুলনায় বাংলাদেশি ওষুধের দাম অনেক কম।

সর্বশেষ খবর