সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

সেভেন সিস্টার্সের দুয়ার খুলেছে আখাউড়ায়

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্, আখাউড়া থেকে ফিরে

সেভেন সিস্টার্সের দুয়ার খুলেছে আখাউড়ায়

বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনার স্থলবন্দর আখাউড়া। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সীমান্তে এ বন্দর দিয়ে নিয়মিতই হচ্ছে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি। এর পাশাপাশি হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমদানি বাণিজ্য। শুধু তা-ই নয়, পর্যটন খাতেও বিপুল রাজস্ব আয়ের সুযোগ সৃষ্টি এখন সময়ের ব্যাপার। ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম, মনিপুর, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল এই সাত রাজ্যকে বলা হয় ‘সেভেন সিস্টার্স’। এই রাজ্যগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে। হচ্ছে রাজস্ব আয়ও। আর এই আখাউড়া রপ্তানি বন্দরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের শত শত ব্যবসায়ী নানা পণ্য রপ্তানি করতে বন্দর ঘেঁষে গড়ে তুলেছেন নানা প্রতিষ্ঠান।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় রয়েছে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির নানা সুযোগ। ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি নানা কাজ ও ভ্রমণের জন্য এই ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট ব্যবহার করছেন পর্যটকরা। এরই মধ্যে ভারতের কলকাতা থেকে নানা পণ্য আশুগঞ্জের নৌবন্দর হয়ে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে যাচ্ছে ত্রিপুরা, মনিপুরসহ সাত রাজ্যে। এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে এ স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’ খ্যাত সাত রাজ্যে যাচ্ছে মাছ, পাথর, সিমেন্ট, ইট, শুঁটকি, প্লাস্টিক সামগ্রী, ফার্নিচার, তুলাসহ ৪২টি পণ্য। এতে আয় হচ্ছে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। এখানকার ব্যবসায়ীদের দাবি, যেন দ্রুত আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের পণ্য বাংলাদেশে আমদানি করার ব্যবস্থা করে সরকার। এদিকে এ স্থলবন্দর ব্যবহার করে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণের সুযোগ এসেছে। এখন জরুরি হয়ে পড়েছে সরকারের বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ। গত বছর জুনে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের সঙ্গে ট্রান্সশিপমেন্টের কার্যক্রম চালু হয়। উদ্বোধনের পর থেকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থলবন্দর আখাউড়া ও নৌবন্দর আশুগঞ্জ বদলে যাচ্ছে। এতে বাণিজ্যিক সাফল্য যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আখাউড়া স্থলবন্দর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার পরই ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলার অবস্থান। এই আগরতলায় রয়েছে বাংলাদেশি পণ্যের ব্যাপক চাহিদা। কারণ ত্রিপুরার এই রাজধানীর সঙ্গে ভারতের মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ অনেকটা বিচ্ছিন্ন। নেই তেমন কোনো যোগাযোগের সুব্যবস্থা। শুধু তা-ই নয়, সেভেন সিস্টার্সের অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গেও ভারতের মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন একটা ভালো নয়। তাই আগরতলা অনেকটা বাংলাদেশমুখী। আর এসব কারণে দুই দেশের সরকার রাজধানী ঢাকা থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর হয়ে সরাসরি আগরতলা পর্যন্ত চালু করেছে বাস সার্ভিস। এখানকার ব্যবসায়ীরা জানান, একসময়ের চাঙ্গা আখাউড়া স্থলবন্দর হঠাৎই ঝিমিয়ে পড়ে। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে ট্রান্সশিপমেন্ট হওয়ায় এ বন্দর এখন অনেকটাই সচল। ১৯৯৪ সালে ভারতের সঙ্গে এই স্থলবন্দর দিয়ে প্রথম বাণিজ্য কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর প্রতিদিন মাছ, পাথর, সিমেন্ট, ইট, শুঁটকি, প্লাস্টিক সামগ্রী, তুলাসহ অন্তত ৪২টি বাংলাদেশি পণ্য ভারতে রপ্তানি হয়। এখানকার ব্যবসায়ীরা প্রত্যাশা করছেন, অচিরেই এ বন্দর দিয়ে ভারতের সঙ্গে আমদানি এবং চীনের সঙ্গে রপ্তানি-আমদানি বাণিজ্য কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগ গ্রহণ করবে সরকার। ব্যবসায়ীদের আশা, ভারতের সাত রাজ্য ও চীনের সঙ্গে আমদানির যোগসূত্র স্থাপিত হলে তিনটি দেশই লাভবান হবে। আখাউড়া স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি নিছার উদ্দিন ভূঁইয়া ভারতীয় পণ্য আমদানির দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে আমরা শুধু রপ্তানি কার্যক্রম করতে পারি। কিন্তু আমদানি কার্যক্রম এখনো চালু হয়নি। তাই দেশের অন্যান্য স্থলবন্দরের মতো আখাউড়াকে আমদানিমুখী করতে হবে।’ সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ঢাকা থেকে আখাউড়ায় রয়েছে সরাসরি ট্রেন যোগাযোগ ব্যবস্থা। তবে দেশের পূর্বের এই স্থলবন্দরে যেতে নেই কোনো দূরপাল্লার পরিবহন। নিজস্ব পরিবহন বা সিএনজি অটোরিকশা ছাড়া এই স্থলবন্দরে যাওয়া সম্ভব হয় না। ফলে সম্ভাবনাময় এই স্থলবন্দরটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে পড়তে হয় ভোগান্তিতে। তবে আশার কথা, এই স্থলবন্দরের ইমিগ্রেশনে ভোগান্তি নেই বললেই চলে। অনেকটা ইমিগ্রেশনে দাঁড়ানো মাত্রই অনুমতি মিলছে। নেই কোনো পর্যটকের লম্বা লাইন। সম্ভাবনাময় এই স্থলবন্দরে মোবাইল নেটওয়ার্ক থাকলেও নেই থ্রি-জি নেটওয়ার্ক। এ ছাড়া স্থলবন্দরে কোনো সরকারি বা বেসরকারি ব্যাংক নেই। এ কারণে ব্যবসায়ীদের পড়তে হচ্ছে বিড়ম্বনায়। তবে বন্দর থেকে কিছুটা দূরে আখাউড়া বাজারে রয়েছে কয়েকটি ব্যাংকের শাখা। কথা হয় কয়েকজন পর্যটকের সঙ্গে। তারা অভিযোগের সুরে বলেন, এখানে লাগেজ বহনে কোনো ট্রলির ব্যবস্থা  নেই। অসুস্থ রোগীদের জন্য নেই হুইল চেয়ার। আসা-যাওয়ার পথে কোনো যাত্রীছাউনি নেই। বৃষ্টি হলে ভিজেই যাতায়াত করতে হয়। এ ছাড়া নেই আবাসিক হোটেল। খাওয়ার জন্য ভালো কোনো রেস্টুরেন্টও নেই। এ ব্যাপারে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি। আখাউড়া স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান উপদেষ্টা আব্বাস উদ্দিন বলেন, কয়েক মাস ধরে এ স্থলবন্দরে রপ্তানি বাণিজ্য কিছুটা নাজুক। আগে ত্রিপুরায় প্রতি মাসে ৩০০ টন রড ও জিআই শিট রপ্তানি হতো। কিন্তু এখন কম হচ্ছে। তিনি বেনাপোল বন্দরের মতো আখাউড়াকে সব ধরনের পণ্য আমদানির অনুমতি দিতে সরকারের প্রতি দাবি জানান। আখাউড়া স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম-সম্পাদক রাজীব উদ্দিন ভূঁইয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আখাউড়া স্থলবন্দর খুবই সম্ভাবনাময়। পূর্ব ভারতের অবহেলিত সাত রাজ্যের সঙ্গে আমাদের যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছে। এখন পণ্য আমদানি যুক্ত হলে ব্যবসা-বাণিজ্য আরও সম্প্রসারিত হবে।’ আখাউড়া স্থলবন্দরের রাজস্ব কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ভারতের সাত রাজ্যে পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ লাভবান হচ্ছে। একইভাবে আমদানি কার্যক্রম চালু হলে দেশ লাভবান হবে।

সর্বশেষ খবর