সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

সিলেটে গ্রামে গ্রামে রাজপ্রাসাদ

আছে হেলিপ্যাড সুইমিং পুল মিনিপার্ক

জিন্নাতুন নূর, সিলেট থেকে ফিরে

সিলেটে গ্রামে গ্রামে রাজপ্রাসাদ

সিলেটে গ্রামে গ্রামে রাজপ্রাসাদের ছড়াছড়ি। এসব আধুনিক অট্টালিকা সেকালের অনেক রাজপ্রাসাদকেও হার মানায়। চোখ ধাঁধানো অট্টালিকাগুলোর মালিক প্রবাসীরা। কোটি কোটি টাকা মূল্যের বাড়িগুলোর প্রবেশমুখে আছে কারুকার্যময় ফটক, চারদিকে টাইলস ও মার্বেলসহ সীমানা প্রাচীর, বাইরের ফটকসহ প্রতি কক্ষে আলাদা সিসি টিভি ক্যামেরা, প্রতি কক্ষে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র। এ ছাড়া বাড়ির সামনে সিমেন্টের তৈরি বিভিন্ন প্রাণীর মূর্তি, সুইমিংপুল, মিনিপার্ক ও জিমনেসিয়াম আছে। কম করে হলেও আট থেকে ১৫ একর জায়গাজুড়ে তৈরি করা হয়েছে অনেক অট্টালিকা। গোটা সিলেটে এ ধরনের বিলাসবহুল বাড়ির সংখ্যা কত তা নির্দিষ্ট করে জানা না গেলেও কমপক্ষে এ ধরনের কয়েকশ বিলাসবহুল বাড়ি আছে বলে স্থানীয়রা জানান। এ বাড়িগুলোর মেঝেতেও ব্যবহার করা হয়েছে দামি টাইলস ও মার্বেল পাথর। কোনো কোনো বাড়ির অভ্যর্থনা স্থানটি দেখে মনে হতেই পারে পাঁচতারকা  হোটেলের লবি। এর কোনোটিতে আবার  হেলিপ্যাডও আছে। সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলায় এমনও গ্রাম আছে যেখানে কাছাকাছি দূরত্বে অন্তত ২৫টি বাড়ি আছে, যেগুলোর মূল্য প্রতিটি প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। বাড়িগুলোতে থাকা বাসিন্দা ও কেয়ারটেকারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাড়িগুলো নির্মাণে সর্বনিম্ন পাঁচ কোটি টাকা এবং শত কোটি টাকারও বেশি খরচ হয়েছে। তবে এসব বাড়ির মালিকরা প্রায় সবাই বিদেশে অবস্থান করেন। দু-এক বছর পর পর দেশে আসেন। তাই বেশির ভাগ সময় বাড়িগুলো খালি থাকে। কেয়ারটেকাররাই রাজপ্রাসাদসম বাড়িগুলোর দেখভাল করছেন। খালি পড়ে থাকায় বর্তমানে কিছু বাড়ি শুটিংয়ের কাজেও ব্যবহূত হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিগত দুই দশকের বেশি সময় ধরে সিলেটে রাজপ্রাসাদসম বাড়ি তৈরির রেওয়াজ চালু হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত প্রবাস আয় ২০১৩-শীর্ষক জরিপে বলা হয়, সিলেটের প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের ৭৫ ভাগই ব্যয় হয় বাড়ি নির্মাণে। আর প্রবাসীরা তাদের পাঠানো অর্থের ৭৮ শতাংশই দেশে জমি কেনার কাজে ব্যয় করেন। তারা উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের চেয়ে বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণেই বেশি আগ্রহী। আর ব্যতিক্রমী নির্মাণশৈলীর কারণে সিলেটে আগত পর্যটকদের অনেকেই এখন বিলাসবহুল এই বাড়িগুলো দেখতে আসছেন। তবে শুধু লোক দেখানোর জন্য এত অর্থ খরচ করে এই বাড়িগুলো তৈরি করা হয় কিনা তা জানতে চাইলে মালিকের প্রতিনিধিরা জানান, পরিবারের কিছু সদস্য দেশের বাইরে থাকেন। তারা দীর্ঘদিন পর যখন দেশে ফেরেন তখন যৌথ পরিবারের সব সদস্য একসঙ্গে মিলে আনন্দ আয়োজন করার উদ্দেশ্যেই এই বাড়ি নির্মাণ করেছেন।  বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে দেখা যায়, বিলাসবহুল বাড়িগুলোর বেশির ভাগই ডুপ্লেক্স। এগুলোতে সর্বনিম্ন ১০টি থেকে সর্বোচ্চ ৩০টি করে রুম আছে। বাড়িগুলোর ভিতরে বিদেশি কায়দায় কিচেন কেবিনেট করা হয়েছে। আলোকসজ্জার জন্য ব্যয়বহুল ঝাড়বাতি এবং সিলিং থেকে স্পট লাইটিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। দেয়ালে বৈচিত্র্য আনতে চিত্রশিল্পীকে দিয়ে বিভিন্ন ল্যান্ডস্কেপের ছবিও আঁকা হয়েছে। আর বাড়িগুলোর প্রবেশদ্বার ও জানালায় দামি সেগুন কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে। ছাদ ও আঙ্গিনায় আছে বিদেশি ফুলের বাগান। এমনকি কিছু বাড়ি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালও বাইরে থেকে আনা হয়। মূলত সিলেটের বিশ্বনাথ, জগন্নাথপুর, বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, নবীগঞ্জ, সুরমাসহ বিভিন্ন উপজেলায় কোটি কোটি টাকা মূল্যের এই বাড়িগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। এসব বাড়ির মধ্যে কিছু বাড়ি লন্ডনের বিভিন্ন নামিদামি ভবনের আদলে তৈরি করা হয়েছে। এ জন্য বাড়িগুলোর নামেও লন্ডনের ছাপ আছে। যেমন— ‘কুইন এলিজাবেথ মহল’, ‘স্কাইলেট ভবন’ ও ‘বাংলা টাউন’ ইত্যাদি। বিয়ানীবাজারের পাটন গ্রামের এক সারিতেই কয়েকটি প্রাসাদসম অট্টালিকার অবস্থান। এর মধ্যে আছে ‘মালিক মহল,’ ‘বাংলাবাড়ি’ ‘লাল বাংলা’ ইত্যাদি। এই বাড়িগুলো তৈরিতে কম করে হলেও পাঁচ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এলাকা ঘুরে দেখা যায়, একটি বাড়ির ভিতরে প্রবেশের আগে বিশাল স্থানজুড়ে পুকুর খনন করে তার ওপর কংক্রিটের ব্রিজ তৈরি করা হয়েছে। সেই ব্রিজে বসার জন্য আলাদা স্থানও বানানো হয়েছে। কিছু বাড়ির মধ্যে ফোয়ারাও লাগানো হয়েছে। এমনকি বাড়ির বাইরেও টাইলস লাগানো হয়েছে। লোহার বিশাল গেটের অপরপ্রান্তে বাগানে নানা প্রজাতির বিদেশি গাছ। বাড়িগুলোর অনেকগুলোতেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রবেশদ্বারের ওপর সিসি টিভি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। কথা হলে ‘বাংলাবাড়ি’র আবদুল করিম বলেন, ‘আমার বড় তিন ভাই তাদের পরিবার নিয়ে দেশের বাইরে থাকেন। সেখানে তারা রেস্টুরেন্টের ব্যবসা করেন। বছরে দুই-একবার বাড়ি আসেন। মূলত তাদের পরিকল্পনাতেই এই বাড়ি করা হচ্ছে।’ তিনি জানান, এ বাড়িটি অনেকটা ক্যালিফোর্নিয়ার আবাসিক বাড়ির আদলে তৈরি করা হয়েছে। আবদুল করিম এ প্রতিবেদককে জানান, তাদের বাড়ির সদস্য সংখ্যা ১২ জন হলেও পুরো বাড়িতে আছে ২৬টি কক্ষ। যার মধ্যে ২৩টি বেডরুম। বাড়িটির বিশাল ডাইনিং রুমে ৬০-৭০ জন একসঙ্গে বসে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া এই বাড়ির দেয়ালজুড়ে চিত্রশিল্পী দিয়ে গ্রামবাংলার ল্যান্ডস্কেপ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তিনি জানান, এই বাড়ি তৈরিতে এখন পর্যন্ত সাড়ে চার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। বর্তমানে বাড়ির সামনের রাস্তা থেকে মূল বাড়ি পর্যন্ত কংক্রিটের ঢালু রাস্তা ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ চলছে। প্রবেশদ্বার তৈরির কাজ শেষে বাড়ি নির্মাণের মোট খরচ পাঁচ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। আবদুল করিম আরও জানান, এ গ্রামের ৭০ শতাংশ বাসিন্দাই লন্ডনে থাকেন। আর কম করে হলেও ২৫টি পরিবারের কোটি টাকা মূল্যের ওপর বাড়ি আছে। জানা গেছে, সিলেটের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বাড়িটি নির্মাণ করেছেন আল হারামাইন গ্রুপের কর্ণধার ও এনআরবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমান নাসির। সিলেট শহরতলির ইসলামপুরে প্রায় আট একর জায়গা ওপর ‘কাজী ক্যাসেল’ নামে নির্মিত এ বাড়িতে হেলিপ্যাডও আছে। তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যখন সিলেটে আসেন তখন হেলিকপ্টার ব্যবহার করেন বলে তার প্রতিবেশী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে নিশ্চিত করেন। এ ছাড়া এ বাড়িতে আরও আছে সুইমিং পুল। এই ক্যাসেলে বিশ্বের ২৯টি দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সমন্বয়ে ২৯টি কক্ষ তৈরি করা হয়েছে। দুবাই, ফ্রান্স, লেবানন ও জার্মানি এই চার দেশের প্রকৌশলী বাড়িটি নির্মাণ করেছেন বলে জানান শিল্পপতি মাহতাবুর রহমান।

সর্বশেষ খবর