শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

ওদের কাছে শিক্ষা ‘বিলাসিতা’

জিন্নাতুন নূর, শ্রীমঙ্গল থেকে ফিরে

ওদের কাছে শিক্ষা ‘বিলাসিতা’

খাসিয়াদের জীবিকার অন্যতম মাধ্যম পান চাষ। বিক্রির জন্য পান বাছাইয়ে তরুণীর ব্যস্ততা —জয়ীতা রায়

দেশের শিক্ষার হার শতভাগে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকার  যেখানে ব্যতিব্যস্ত, উল্টোদিকে সিলেটের খাসিয়া নৃগোষ্ঠীর মানুষের কাছে শিক্ষা গ্রহণ এক ধরনের ‘বিলাসিতা’। পর্যাপ্ত সরকারি বিদ্যালয় না থাকায় ও যাতায়াত সমস্যার কারণে খাসিয়া শিশুরা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে না। বহু কষ্টে খাসিয়াদের সন্তান প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করতে পারলেও এই শিশুদের অর্ধেকই বাসস্থানের কাছাকাছি মাধ্যমিক বিদ্যালয় না পেয়ে শিক্ষা জীবনের ইতি টানছে। আর শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ না থাকায় খাসিয়ারা আধুনিক জীবন ব্যবস্থা গ্রহণে আগ্রহী হলেও পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে যাওয়ার পথে রেল লাইনের ঠিক পাশ ঘেঁষেই মাগুরছড়া খাসিয়াপুঞ্জির অবস্থান। টিলার ওপর আঁকাবাঁকা উঁচু-নিচু পথে পুরো পুঞ্জিতে বর্তমানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ৭০ থেকে ৮০টির বেশি খাসিয়া পরিবার। এখানকার বাসিন্দাদের প্রধান পেশা পান উৎপাদন। পান উৎপাদন ছাড়াও চা বাগানের কাজ,  লেবু, আনারস, কাঁঠাল, কমলা চাষেরও কাজ করে তারা। মূলত খাসিয়ারা মাতৃতান্ত্রিক গোষ্ঠী। তাই নারীরাই পরিবারে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। পাহাড়-টিলা ও ঝোপজঙ্গল পরিবেশে থেকে তারা অভ্যস্ত। তবে নতুন প্রজন্মের খাসিয়ারা শুধু কৃষিকাজকে পেশা হিসেবে নিয়ে জীবন কাটাতে আগ্রহী নয়। তারা বর্তমানে সম্মানজনক চাকরি ও বেসরকারি এনজিওতেও কাজ করতে চান। কিন্তু এজন্য তাদের প্রয়োজন শিক্ষা। সরেজমিন মাগুরছড়া খাসিয়াপুঞ্জি ঘুরে দেখা যায়, এখানকার শিশুদের শিক্ষা গ্রহণের আগ্রহ থাকলেও তারা সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত। আর যাতায়াত ব্যবস্থার জন্য উচ্চ শিক্ষাও নিতে পারছে না খাসিয়া শিশু। ডারনেট সুংআ নামের এক খাসিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার সন্তানদের আমি লেখাপড়া করাচ্ছি। বুঝতে পারছি যে, শুধু পানচাষের মধ্যেই যদি আমরা সীমাবদ্ধ থাকি তাহলে জীবনের উন্নতি হবে না। কিন্তু শিক্ষা অর্জন করা আমাদের কাছে কেবল ‘বিলাসিতা’। সন্তানকে দূরে স্কুলে পড়াতে অনেক টাকা লাগে। এই অর্থ আমরা কোথায় পাব!’ এই পুঞ্জিতে মাগুরছড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও এখানে কোনো উচ্চ বিদ্যালয় নেই। শহর থেকে ৭ কি.মি. দূরে গিয়ে পুঞ্জির ছেলেমেয়েদের উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষা নিতে হচ্ছে। আর সচ্ছল খাসিয়াদের কেউ কেউ পুঞ্জি থেকে দূরে শ্রীমঙ্গল শহরে আত্মীয়ের বাড়ি ও চার্চে রেখে তাদের সন্তানদের লেখাপড়া করাচ্ছেন। কিন্তু এ সংখ্যা বেশি নয়।  রিদালিয়ান নামে ষষ্ঠ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বলে, ‘আমি প্রতিদিন সিএনজিতে করে অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে স্কুলে যাই। খরচ বেশি বলে অনেকদিন স্কুলে যাই না।’ জানা যায়, মৌলভীবাজারের ৬টি উপজেলায় ৬১টি পুঞ্জিতে মোট ২ হাজার ৩৯২টি খাসিয়া পরিবার বাস করে। এসব পরিবারের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৭ হাজার। পুঞ্জিগুলোর অবস্থান শহর জনপদ থেকে সর্বনিম্ন ১০-১২ কি.মি. থেকে সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৩৫ কি.মি. পর্যন্ত দূরের পাহাড়ি এলাকায়। এই পুঞ্জিগুলোতে প্রাথমিক বয়সী শিশুর বর্তমান সংখ্যা প্রায় দুই হাজার এবং মাধ্যমিক বয়সী শিশুর সংখ্যা প্রায় ১২০০। পুঞ্জিগুলোতে এনজিও, মিশনারি বা পুঞ্জির নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও কমলগঞ্জের ডাবলছড়া পুঞ্জির একটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছাড়া আর কোনো পুঞ্জিতে মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই। খাসিয়ামন্ত্রী জিডিসন প্রধান সুচিয়াং বলেন, প্রাথমিক শ্রেণি উত্তীর্ণ হওয়ার পর এই শিশুর অর্ধেকই বাসস্থানের কাছাকাছি মাধ্যমিক বিদ্যালয় না পেয়ে লেখাপড়া ছেড়ে দিচ্ছে। আর  মেয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণের হার আরও করুণ। ঝরে পড়া শিশুগুলো উপায় না থাকায় তাদের পারিবারিক পেশায় ফিরে যায়। এজন্য তিনি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারিভাবে হোস্টেল নির্মাণ ও পুঞ্জিতে আরও মাধ্যমিক স্কুল নির্মাণের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

সর্বশেষ খবর