শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

বাতির নিচে অন্ধকার চরসোনারামপুর

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্, আশুগঞ্জ (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) থেকে ফিরে

বাতির নিচে অন্ধকার চরসোনারামপুর

আশুগঞ্জে রয়েছে দেশের অন্যতম নৌবন্দর। রয়েছে বৃহত্তর সারকারখানা। আরও রয়েছে বৃহত্তর গ্যাস ট্রান্সমিশন ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। এই বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের বিদ্যুতে আলোকিত হচ্ছে দেশের সিংহভাগ এলাকা। কিন্তু সেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রেরই পাশের গ্রাম চরসোনারামপুর, যেখানে এখনো বিদ্যুৎ পৌঁছেনি। আশুগঞ্জের মাত্র ৫০০ মিটার দূরে এ চরসোনারামপুর। এখানে বিদ্যুৎ ব্যবহারের কোনো ব্যবস্থাই নেই। রাতের বেলা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ঝকমকে নানা রঙের বাতি জ্বললেও চরসোনারামপুর গ্রাম থাকছে অন্ধকারে ডুবে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গ্রামের ১০ হাজার মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত। ঘরে-বাইরে কোথাও আলো নেই, এমনকি আলো নেই স্কুল পড়ুয়াদের জন্যও। দিন শেষে এখানে সন্ধ্যা নামে অন্ধকারকে আলিঙ্গন করে।

ওয়াকিবহাল অনেকেই জানান, বিদ্যুৎ নেই কিন্তু এর পাশাপাশি প্রতিশ্রুতিরও কমতি নেই। জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে দায়িত্বশীল অনেকেই এলাকাবাসীর জন্য কেবল প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছড়িয়ে যাচ্ছেন। স্থানীয়দের ভাষ্য, ‘ভাবা যায়! গ্রামের ওপর দিয়ে ১৩২ কেভি গ্রিড লাইন দিয়ে সারা দেশে যাচ্ছে বিদ্যুৎ। সে বিদ্যুতে আলোকিত হচ্ছে শহর-বন্দর-দেশ। কিন্তু সে গ্রিড লাইনের নিচেই থাকছে ঘোর অন্ধকার!’ 

আশুগঞ্জের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর নাম মেঘনা। এই নদীর পানি দিয়েই উৎপাদন হচ্ছে বিদ্যুৎ। যে বিদ্যুতে রাতের অন্ধকার দূর হচ্ছে আশুগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের। অথচ মেঘনা নদীর মাঝেই ভেসে রয়েছে চরসোনারামপুর গ্রাম। এটি আশুগঞ্জ উপজেলার আশুগঞ্জ সদর ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। গ্রামটি ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ড, যার নম্বর ২। এ ওয়ার্ডে একজন ইউপি সদস্যও রয়েছেন। এক মহিলা ইউপি সদস্যের বাড়িও এ গ্রামে। রয়েছে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কমিউনিটি ক্লিনিক। আছে মোবাইল নেটওয়ার্কও। কিন্তু নেই কেবল বিদ্যুৎ।

বন্দরনগরী আশুগঞ্জ বাজার থেকে ঠিক দুই মিনিটের নদী পথ পাড়ি দিলেই চরসোনারামপুর গ্রাম। চর হলেও এখানে বসতি অন্তত দশ হাজার। সবুজ গাছে আচ্ছাদিত গ্রাম। বাসিন্দাদের সিংহভাগই হিন্দু সম্প্রদায়ের। গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, ‘শুধু বিদ্যুতের অভাবে আমার তিন ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা করাতে পারিনি। এ গ্রামের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই বিদ্যুৎ আর যাতায়াত সমস্যার কারণে প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পারে না।’ আরেক প্রবীণ বাসিন্দা বাসিন্দা যতিশ বর্মণ বলেন, ‘বিদ্যুতের অভাবে আমরা অন্ধকার জীবন-যাপন করছি। অনেকেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কিন্তু ভাগ্যে বিদ্যুৎ আর জোটেনি।’ বৃদ্ধা নরেশ চন্দ্র বর্মণ বলেন, ‘বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে আমার ৪ ছেলে-মেয়ের কেউ পড়াশোনা করতে পারেনি।’ আশুগঞ্জের ব্যবসায়ী ইসহাক সুমন বলেন, ‘চরসোনারামপুর গ্রামটি যেন বাতির নিচে অন্ধকারের গ্রাম।’ ব্যবসায়ী শীতল বর্মণ বলেন, ‘নদীর এই পাড়ে উৎপাদিত হয় বিদ্যুৎ। আর এই বিদ্যুৎ দিয়ে চলে দেশের বেশিরভাগ এলাকা। অথচ পাশেই চরসোনারামপুর গ্রামে নেই বিদ্যুতের ব্যবস্থা।’ মনোলাল বর্মণ বলেন, ‘আমরা বিদ্যুৎ না পাইয়া হারিকেন, কুপি দিয়া আলো জ্বালাইয়া জি-পুত নিয়া আছি।’ ২ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার হেলাল খান বলেন, ‘চরসোনারামপুর গ্রামে বিদ্যুৎ আনার জন্য বহু চেষ্টা করছি। কিন্তু কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না।’ একই কথা বলেন মহিলা ইউপি সদস্য কবিতা রানী দাস। এলকাবাসীর মতে, এখানে নৌপথে পণ্য পরিবহনের সুবিধা রয়েছে। ফলে এখানে গড়ে উঠতে পারে শিল্পকারখানা। রয়েছে বিপুল পরিমাণ জমিও। তাই এই গ্রামের উন্নয়নে নজর দেওয়া প্রয়োজন। আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী চন্দন কুমার সূত্রধর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাধারণত স্থানীয়ভাবে ১১ থেকে ১২ মিটার উচ্চতার খুঁটি দিয়ে টানা হয় বিদ্যুৎ লাইন। কিন্তু মেঘনা নদীর ওপর দিয়ে অন্তত ৫০০ মিটার দীর্ঘ খুঁটি দিয়ে সঞ্চালন লাইন হওয়ায় এই গ্রামে বিদ্যুৎ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, আশুগঞ্জ বাজার থেকে গ্রামের দূরত্ব ৫০০ মিটার। আর এই ৫০০ মিটার দূরত্বে খুঁটি দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব নয়।  ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান জিয়াউল হক মৃধা বলেন, ‘নদীর তলদেশ দিয়ে হোক বা অন্য কোনো পথে হোক- চরসোনারামপুরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা অতি জরুরি। আমি আশা করি সংশ্লিষ্টরা এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবেন।’

সর্বশেষ খবর