মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

অনিয়ম-বঞ্চনা পদে পদে

জিন্নাতুন নূর, শ্রীমঙ্গল থেকে ফিরে


অনিয়ম-বঞ্চনা

পদে পদে

শ্রীমঙ্গলের চা বাগানের শ্রমিকরা পদে পদে নানা অনিয়মের শিকার হচ্ছেন। এমনকি চা শ্রমিক সংক্রান্ত যে চুক্তি রয়েছে তার কোনো তোয়াক্কা না করেই বছরের পর বছর শ্রমিকদের সঙ্গে মালিক কর্তৃপক্ষ বঞ্চনা করে যাচ্ছে। চা বাগানের বরাদ্দকৃত জমিতে স্বল্প পরিসরে পরিবার নিয়ে থাকলেও নিজস্ব জমি না হওয়ায় শ্রমিকদের সন্তানরা সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিতে গিয়ে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন। এ ছাড়া নিজের জমি না হওয়ায় তারা সর্বদাই উচ্ছেদ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা জানান, বেঁচে থাকার প্রয়োজনে চা শ্রমিকদের ভাতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। একই সঙ্গে শ্রম আইনে চা শ্রমিকদের উচ্ছেদ সংক্রান্ত যে আইন আছে তারও সংশোধনের দাবি জানান তারা। সরেজমিন গান্ধীছড়া চা বাগানের শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোনো শ্রমিক বাগান কর্তৃপক্ষের দেওয়া ঘরের বাইরে আলাদাভাবে ঘর বানাতে চাইলে বাগান কর্তৃপক্ষ ঘর তৈরির অনুমতি দেয় না। এমনকি কেউ ঘর তৈরির উদ্যোগ নিলে সেই শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করার হুমকিও দেওয়া হয়। অথচ শ্রম আইনের ৩২-ধারায় চা শ্রমিকদের জন্য বলা হয়েছে, একজন শ্রমিক অবসরে যাওয়ার পরই তাকে তার বাড়ি থেকে এক মাসের মধ্যে উচ্ছেদ করা হবে। এই বাগানের মালিকদের দেওয়া ঘরগুলোতে পল্লীবিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে খুব বেশি বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি এই বিদ্যুৎ দিয়ে চালানো সম্ভব নয়। কিন্তু মাস শেষে শ্রমিকের বেতন থেকে বাগান কর্তৃপক্ষ বিদ্যুৎ বিলের টাকাও কেটে রাখছে। এমনকি হাঁস-মুরগি পালনের জন্য চা শ্রমিকদের কাছ থেকে মালিক কর্তৃপক্ষ বছরে ১৫ টাকা করে কর কেটে নিচ্ছে। আর যদি কোনো চা শ্রমিকের গরু-ছাগল চা বাগানে ঢুকে যায় তাহলে ৫০ থেকে ১০০ টাকা জরিমানা করা হয়। শ্রমিকদের ঘরে যে মাটির চুলা আছে তার জন্যও বছরে ১২ টাকা কর দিতে হয়। চা বাগানে শ্রমিকদের কাজ করার ধরন অনেকটা বংশানুক্রমে হয়ে আসছে। যেমন একজন শ্রমিক বাগানে কাজে প্রবেশ করলে তার ছেলে যখন কাজের উপযুক্ত হবে তখন সেও তার বাবার মতো বাগানে শ্রমিক হিসেবে যোগদান করবে। এমনকি না চাইলেও সে ছেলে বিয়ে করলে তার স্ত্রীকেও শ্রমিক হিসেবে বাগানের কাজে ঢুকতে হবে। তবে উন্নত জীবন-যাপনের উদ্দেশে অবহেলার জীবন থেকে বেরিয়ে এসে এখন শ্রমিকদের সন্তানরা শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহিত হচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় গান্ধীছড়া চা বাগানের বেশ কয়েকজন শ্রমিক এই প্রতিবেদককে জানান, শুধু নিজস্ব বাড়ি (জমি) বা বাসস্থানের ঠিকানা না থাকায় উচ্চশিক্ষা নিয়েও অনেক শ্রমিকের সন্তান চাকরির সুযোগ পাচ্ছেন না। সম্প্রতি পুলিশ বাহিনীতে কলিন্স রোজারিও ও রাজু সাহা নামে দুই চা শ্রমিকের সন্তান পুলিশের কনস্টেবল পদে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হন। কিন্তু তাদের মা-বাবার ভূ-সম্পত্তি না থাকায় তারা প্রথমে চাকরি পাননি। এর মধ্যে কলিন্স মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার গাজীপুর চা বাগানের বাসিন্দা। আর রাজু কমলগঞ্জের বাঘাছড়ার। পরে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান এ বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করেন। তিনি মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ একাধিক মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠান। অবশেষে ভাগ্য সহায় হয় কলিন্স ও রাজুর। তারা পুলিশ বাহিনীতে চাকরির সুযোগ পান। তবে এত বঞ্চনার পরও কিছু চা শ্রমিকের সন্তান প্রতিকূলতা ঠেলে মনের জোরে এগিয়ে যাচ্ছেন। তাদেরই একজন অজিত দাস। চা শ্রমিক অনিল দাসের এইচএসসি পাস সন্তান নিজ যোগ্যতায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে চাকরির সুযোগ পেয়েছেন। এ ছাড়া চা শ্রমিক কৈলাস দাসের স্নাতক পাস সন্তান সুমন দাসও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকরির সুযোগ পেয়েছেন। জানা যায়, ২০১৫ সালের চুক্তি অনুযায়ী চা শ্রমিকরা অবসরে গেলে এককালীন এক লাখ ২০ হাজার টাকা পাবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত গান্ধীছড়াসহ শ্রীমঙ্গলের আরও বহু শ্রমিক এই টাকা পাননি। শ্রমিকরা জানান, চুক্তি অনুযায়ী চা শ্রমিকদের মধ্যে যারা ড্রেসারের কাজ করবেন তাদের জন্য বাসা বরাদ্দের কথা থাকলেও এর বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এ ছাড়া শ্রীমঙ্গলের চা বাগানগুলোতে বাগানের একজন স্টাফ/বাবুর সেবার জন্য চুক্তি মোতাবেক একজন শ্রমিক নিয়োগের কথা থাকলেও বাস্তবে নিয়োগ করা হচ্ছে চার থেকে পাঁচজন শ্রমিক। চা শ্রমিক মালতি রানী জানান, যদি নির্দিষ্ট সময়ের পাঁচ মিনিট পরে কর্মস্থলে পৌঁছাই তাহলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এতে সেদিনের মজুরি কাটা পড়ে। এমনকি যদি কারও শরীর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে তবে তাকে সাধারণ কিছু ওষুধ দিয়ে বসিয়ে রাখা হয়। বাসায় যেতে দেওয়া হয় না। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রাম ভজন কৈরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের চা কোম্পানিগুলো যে মুনাফা পায় সেখানে চা শ্রমিকদেরও সুবিধা ভোগ করার কথা। কিন্তু এটি মানা হচ্ছে না। এ ছাড়া শ্রমিকদের জন্য সরকার যে চা শ্রমিক ভাতা দিচ্ছে তা আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। শ্রম আইনে চা শ্রমিকদের অবসরে যাওয়ার পর ভূমি থেকে উচ্ছেদ সংক্রান্ত আইনের সংশোধন দাবি করেন তিনি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর