বুধবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

পুষ্টিহীনতা আর টানা পরিশ্রমে বাঁধা জীবন

জিন্নাতুন নূর, শ্রীমঙ্গল থেকে ফিরে

পুষ্টিহীনতা আর টানা পরিশ্রমে বাঁধা জীবন

শ্রীমঙ্গলের চা বাগানে কর্মরত শ্রমিকদের জীবন পুষ্টিহীনতা, ডায়রিয়া, চর্মরোগ এবং গর্ভকালীন সমস্যাসহ নানা রোগ-শোকে ভুগতে ভুগতে ক্ষয়ে যাচ্ছে। কি পুরুষ, কি নারী, সব শ্রমিকই ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে আছে। বিশেষ করে মাতৃত্বকালীন সময় মজুরির আশায় ছুটিতে না গিয়ে ঝুঁকি নিয়ে নারী শ্রমিকরা কাজ করছেন। আর গর্ভকালীন সময়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টানা কয়েক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে পরিশ্রম করায় মা ও গর্ভের সন্তান উভয়ের ক্ষতি হচ্ছে।

সাধারণত নারীরা চা বাগানে পাতা সংগ্রহ, নার্সারিতে গাছের কলম তৈরি এবং চারা সংগ্রহ ইত্যাদি কাজ করেন। বেশ কজন নারী শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চা বাগানে কাজ করতে গিয়ে প্রায়ই তাদের গর্ভপাত হয়। কারণ এই শ্রমিকরা গর্ভধারণের পর থেকে সন্তান প্রসবের আগ পর্যন্ত ছুটি নেন না। সন্তানকে পেটে নিয়েই রোদে পুড়ে আট ঘণ্টা দাঁড়িয়ে টানা কাজ করে যান। অথচ একজন প্রসূতি মায়ের এই সময়ে যে পরিমাণ বিশ্রাম ও সুষম খাদ্য খাওয়া প্রয়োজন তার কিছুই তাদের কপালে জুটে না। এ ছাড়া সন্তান প্রসবের সময়েও অনেক নারী শ্রমিকের জটিলতা দেখা দেয়। অপুষ্টিরশিকার গর্ভবতী একজন নারী শ্রমিক যে সন্তানের জন্ম দেন, সে সন্তানও নানা প্রতিবন্ধিতা নিয়ে জন্ম নেয়।  গান্ধিছড়া চা বাগানের দুই গর্ভবতী নারী শ্রমিক রীনা ও বিনতী। তাদের সঙ্গে কথা হলে এই প্রতিবেদককে তারা জানান, প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত টানা কাজ করার ফলে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে বেশ কষ্ট পান। এজন্য নানা ধরনের শারীরিক সমস্যাও দেখা দেয়। কিন্তু উপায় না থাকায় কষ্ট সহ্য করে হলেও তারা কাজ করছেন। এদিকে গান্ধিছড়া চা বাগানের ৯ নং ছড়ায় পানি শ্রমিকরা কাজের ফাঁকে গোসল ও হাতমুখ ধোঁয়া এবং পানের কাজে ব্যবহার করেন। কিন্তু এই ছড়ার পানিতে পাশের একটি রাবার বাগানের কারখানায় ব্যবহৃত ক্ষতিকর রাসায়নিক ও অ্যাসিড এসে সরাসরি পড়ছে। আর বিষাক্ত এই পানি ব্যবহারের ফলে শ্রমিকরা নানা রকম শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। কজন শ্রমিক এই প্রতিবেদককে অভিযোগ করেন, ছড়ার পানি ব্যবহারের ফলে তাদের অনেকের মাথার চুল পড়ে যাচ্ছে। কারও কারও শরীরে চর্মরোগ দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া চা বাগানের যে শ্রমিকরা বাগানে কীটনাশক ছিটানোর কাজ করেন তাদের বাগান কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে বাধ্যতামূলক সাবান, চশমা ও জুতা দেওয়ার কথা থাকলেও গান্ধিছড়া বাগানের কীটনাশক ছড়ানোর কাজে জড়িত শ্রমিকরা এর কিছুই পাচ্ছেন না। এর ফলে এই শ্রমিকরা চরম স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। শ্রমিকরা এই প্রতিবেদকের কাছে আরও অভিযোগ করেন, চা বাগানের মধ্যে স্যানিটেশন ব্যবস্থা অত্যন্ত খারাপ। এর ফলে শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা প্রায়ই ডায়রিয়া ও পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন। এ ছাড়া গান্ধিছড়া চা বাগানের গ্রামের কয়েকশ শ্রমিকের জন্য আছে মাত্র ৫-৬টি নলকূপ। যা দিয়ে পানির চাহিদা মেটানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। আবার শ্রমিকদের যদি বড় ধরনের রোগ হয় তাহলে মালিক পুরো খরচ দেন না। চিকিত্সার অর্ধেক খরচ মালিক দেন বাকি অর্ধেক খরচ শ্রমিককেই জোগাড় করতে হয়।  খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নামমাত্র মজুরিতে পুষ্টিকর খাবার কিনতে না পারায় শ্রমিক ও তাদের পরিবার অপুষ্টিতে ভোগেন। এই শরীরে টানা ৮ ঘণ্টা কাজ করে তাদের মাথা  ঘোরে, হাত-পা ঝিমঝিম করে। মেয়েরা জানান, অনেকের শরীরে পেশীগুলোতে এত বেশি ব্যথা করে যে বাড়ি ফিরে আর কাজ করার মতো ক্ষমতা থাকে না। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি চা বাগানে মেডিকেল টিম থাকার কথা। কিন্তু শ্রমিকদের অভিযোগ সেখানে ভিন্ন ভিন্ন রোগ হলেও ওষুধ দেওয়া হয় এক রোগের। সন্ধ্যা রানী নামের এক শ্রমিক বলেন, ‘মাথা ব্যথা হলে প্যারাসিটামল, বুকে ব্যথা হলে প্যারাসিটামল আবার পেটে ব্যথা হলেও সেই প্যারাসিটামল খেতে দেওয়া হয়।’ বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রাম ভজন কৈরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাধারণত শ্রম আইন অনুযায়ী সন্তান প্রসবের দুই মাস আগে ও প্রসবের দুই মাস পর শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি পাওয়ার অধিকার আছে। আর এই ছুটির তিন মাস আগে শ্রমিকের কাজের পারফরম্যান্স (ধরন) দেখেই ছুটিতে থাকার সময় শ্রমিকের মজুরি নির্ধারিত হয়। কিন্তু শ্রমিকরা বেশি মজুরি লাভের আশায় গর্ভ ধারণের শেষ সময়ে এসেও ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। যাতে ছুটিতে ভালো মজুরি পান। তার মতে এ সময় প্রসূতি ভাতার প্রচলন করা উচিত। আর গর্ভবতীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সংশ্লিষ্টদের সপ্তাহে অন্তত দুই হাজার টাকা অর্থ বরাদ্দ করা উচিত। এ ছাড়া তিনি স্বীকার করেন যে, শ্রীমঙ্গলের অনেক কীটনাশক ছড়ানোর কাজে জড়িত চা শ্রমিক সুরক্ষামূলক উপকরণ পান না।

সর্বশেষ খবর