বৃহস্পতিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

ঘুষ দিয়েও ক্ষতিপূরণের চেক মিলছে না ঢাকা ডিসি অফিসে

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজের জমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকরা ক্ষতিপূরণের টাকা পাচ্ছেন না। রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী পর্যন্ত নির্মাণাধীন এ প্রকল্পের জন্য তাদের যৎসামান্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে সেটা নিয়ে চলছে নানা দুর্নীতি আর হয়রানি। ঘুষ দিয়েও ঢাকা ডিসি অফিসের এলএ (ভূমি অধিগ্রহণ) শাখা থেকে ক্ষতিপূরণের টাকা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বাস্তুহারারা অর্থকষ্টে পথে পথে ঘুরছেন। কিছুদিন আগেও তাদের বাড়ি গাড়ি ছিল আর এখন স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কোনোমতে জীবন-যাপন করছেন—এমন ঘটনাও রয়েছে। তাদের কেউ কেউ ঠিকমতো বাসা ভাড়াও দিতে পারছেন না। নাখালপাড়ার একজন ক্ষতিগ্রস্ত জানান, অর্থের অভাবে সন্তানের জন্য দুধ কিনতেও পারছেন না।

রসুলবাগ এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত নাদির উদ্দিন বলেন, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মিত হলে হয় তো ঢাকার চেহারা পাল্টে যাবে।

কিন্তু আমাদের মতো যাদের বাড়িঘর অধিগ্রহণ করে স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে, তাদের ভাগ্যে কী আছে? আমরা তো ডিসি অফিসে ঘুরে ঘুরে জুতার তলা ক্ষয় করেও ক্ষতিপূরণের টাকা পাচ্ছি না। সরকার এলএ শাখায়  ক্ষতিপূরণের ১২০০ কোটি টাকা মজুদ রাখলেও কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার স্বেচ্ছাচারিতায় সেটা আমরা পাচ্ছি না। নানা অজুহাতে তারা সে টাকা ক্ষতিগ্রস্তদের দিচ্ছে না।

জানা যায়, বর্তমানে বেশ কয়েকটি চক্র ডিসি অফিসের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মচারীর সহযোগিতায় বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত বিলের ওপর আপত্তি দিচ্ছে। তারা একটি সাদা কাগজের ওপর সে আপত্তির আবেদন করছে, যার অধিকাংশই ভুয়া ওয়ারিশ কিংবা জাল মালিক। আর সেটা এডিসি এলএ’র মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট শাখায় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হচ্ছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের টাকা পেতে আরও দেরি হচ্ছে। ৬ ও ৭ ধারার নোটিসের পরও দুর্নীতিবাজরা আদালতে কোনোরকমে একটি মোকদ্দমা দিয়ে একটি নম্বর ফেলে ডিসি অফিসে গিয়ে আপত্তি দিচ্ছে। যাতে মানুষের হয়রানি আরও বেড়ে যায়। এসব আপত্তি দ্রুত নিষ্পত্তি করে সঠিক ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে বিল দেওয়ার পরিবর্তে হয়রানি করা হচ্ছে। তা ছাড়া এসব আপত্তি দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়ায় ডিসি অফিসের দুর্নীতিবাজ চক্র সুযোগ নিচ্ছে। যাদের ফাইলে আপত্তি পড়ছে তাদের নানাভাবে বোঝানো হচ্ছে, নির্দিষ্ট পরিমাণ ঘুষ না দিলে সে আপত্তি নিষ্পত্তি হবে না। আর সেটা না হলে ক্ষতিপূরণের বিল পেতে বছরের পর বছর ঘুরতে হবে। যার কারণে অনেকে নিরুপায় হয়ে দুর্নীতিবাজদের হাতে মোটা অঙ্কের ঘুষ তুলে দিচ্ছেন।

ডিসি অফিস সূত্রে জানা গেছে, কোনোরকম দলিলপত্র, পর্চা, হালনাগাদ নামজারি কিংবা খাজনার রসিদ ছাড়া এডিসি এলএতে সাদা কাগজে আপত্তি গ্রহণ করা ঠিক নয়। কারণ, এর ফলে সেখানে একটি আপত্তি কেস সৃষ্টি হয়। যার মাধ্যমে নোটিস জারি করে দুই পক্ষকে তলব করে সময়ক্ষেপণ করা হয়। তাই কেউ আপত্তি দিলে তার কাছে সে জমির হালনাগাদ মালিকানার কাগজপত্র দাবি করা উচিত। তা না হলে সংশ্লিষ্ট অভিযোগকারীর আবেদন গ্রহণ করা উচিত নয়। হালনাগাদ কাগজপত্র দেখাতে না পারলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো কোনো ক্ষেত্রে জালিয়াতির অভিযোগ করা যায়।

একাধিক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত বছরের শেষ দিকে ক্ষতিগ্রস্তদের ৯০টি চেক দেওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে ঢাকার এডিসি এলএ আবদুল্লাহ আল মামুন ৫৩টি চেক বিতরণ করে বলেন, আগামী সপ্তাহে অবশিষ্ট চেকগুলো বিতরণ করা হবে। কিন্তু অদ্যাবধি সেটা বিতরণ করা হয়নি। এ ব্যাপারে ক্ষতিগ্রস্তদের কেউ কেউ তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, চেকগুলো পুনরায় যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এভাবে কালক্ষেপণ করে চেক হস্তান্তর কাজ আটকে রাখা হচ্ছে।

এলএ শাখা সূত্রে জানা যায়, বাড়িঘর, জমিজমা ও অন্যান্য স্থাপনার মালিকানার কাগজপত্র যাচাই-বাছাই এবং সঠিক ওয়ারিশ নির্ণয়ের পরই চেক তৈরি করা হয়। সেটা করতে বেশ সময় চলে যায়। পুনরায় এটা করা হলে সময় অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। এর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। যে কোনো সময় এটা বিস্ফোরিত হতে পারে। তখন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ রাজপথে নেমে পড়া ছাড়া আর কোনো গতি থাকবে না। এর ফলে প্রকল্পের কাজ বিঘ্নিত হয়ে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে।

সরেজমিন মহাখালী, রসুলবাগ, নাখালপাড়া ও মগবাজার এলাকায় গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের হাহাকার দেখা গেছে। মগবাজার রেলগেটের কাছে বৃদ্ধ হাসেম আলী ভাঙা বাড়ির পাশেই দাঁড়িয়ে অশ্রুপাত করছেন। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কেঁদে উঠলেন। বললেন, বাবা, এক চিলতে জমির ওপর ৬ তলা বাড়ি নির্মাণ কাজ মাত্র শেষ হয়েছে। বাড়ি ভাড়ার টাকায় সংসার চলত। এর মধ্যে তা অধিগ্রহণ হয়ে যায়। এখন সব হারিয়ে পথে বসেছি। অনেক ঘোরাঘুরি করেও ক্ষতিপূরণের টাকা পাচ্ছি না। চেক আজ দেব কাল দেব বলে শুধু ঘুরানো হচ্ছে।

এলএ শাখা সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে ১২০০ কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। অধিগ্রহণের দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও ১২০০ কোটি টাকা থেকে গত এক বছরে মাত্র ২০০ কোটি টাকার চেক দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তরা বেঁচে থাকতে বাকি টাকা পাবেন কিনা সে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

এলএ শাখার একাধিক কর্মকর্তা জানান, এডিসি এলএর অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণেও ক্ষতিগ্রস্তদের চেক হস্তান্তরে  দেরি হচ্ছে। যে কোনো জমি অধিগ্রহণ কাজের বিশেষজ্ঞ হলেন ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা (এলএও)। অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ কাজে সব রকম দায়-দায়িত্ব তার ওপর বর্তায়। এডিসি এলএ শুধু ওই কাজে দেখাশোনা কিংবা তত্ত্বাবধান করে থাকেন। কেউ কোনো অভিযোগ করলে সেটাও তিনি খতিয়ে দেখতে পারেন। কিন্তু বর্তমান এডিসি এলএ সব কিছু নিজের আয়ত্তে রেখে ক্ষতিপূরণের কাজ দীর্ঘায়িত করছেন।

এডিসি এলএ আল মামুন বলেন, এত দিন ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা ছিলেন না বলে কাজে কিছুটা ধীরগতি এসেছিল। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের চেক দিতে কিছুটা দেরি হয়েছে। তবে বর্তমানে দ্রুত গতিতে কাজ চলছে। আগামী সপ্তাহ থেকেই চেক দেওয়া শুরু হবে। তখন আর ক্ষতিগ্রস্তদের কোনো অভিযোগ থাকবে না।

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজে সরকার যে ২৪৭ একর জমি অধিগ্রহণ করেছে তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১২০০ কোটি টাকা দিতে হবে। কিন্তু হাজার হাজার ভূমি মালিকের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, তারা বাস্তুহারা হারানো সম্পত্তির ক্ষতিপূরণ আনতে গিয়ে নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ঘুষ না দিয়ে কেউই তাদের চেক পাচ্ছেন না। যারা ঘুষের টাকা ব্যাংক চেক হিসেবে কর্মকর্তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন শুধু তারাই ক্ষতিপূরণের চেক হাতে পাচ্ছেন।

রসুলবাগ, নাখালপাড়া ও মগবাজারের বেশ কয়েকজন ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিক অভিযোগ করেছেন, মালিকানার সব কাগজপত্র থাকার পরও তাদের ক্ষতিপূরণের ১০ থেকে ২০ ভাগ টাকা ঘুষ হিসেবে দিতে হয়েছে। কেউ কেউ ৩০ থেকে ৪০ ভাগ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিয়ে ক্ষতিপূরণের টাকা হাতে পেয়েছেন। এ ঘুষ দিতে গিয়ে তাদের ফার্মগেটের বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের গ্রিন রোড শাখায় নতুন করে অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়েছে। সে অ্যাকাউন্টে ক্ষতিপূরণ হিসেবে পাওয়া চেক জমা দিতে বাধ্য করা হয়। ব্যাংক ম্যানেজারের সহযোগিতায় আগের ঘুষের টাকা ক্যাশ করা হয়। পরে  ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়া হয়।

একাধিক ভুক্তভোগী জানান, কোটি কোটি টাকার ঘুষ নেওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করতে কারও সাক্ষীর দরকার নেই। ঘুষের সব প্রমাণ কমার্স ব্যাংকের গ্রিন রোড শাখার নথিপত্রেই রয়েছে। ঢাকায় এত ব্যাংক থাকতে শুধু কমার্স ব্যাংকের নির্দিষ্ট শাখায় কেন অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। সেখানকার অ্যাকাউন্ট চেক করলেই পার্সেন্ট অনুযায়ী ঘুষের প্রমাণ পাওয়া যাবে। কে চেক জমা দিয়েছেন আর কে চেক দিয়ে সে অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলেছেন তার সবকিছুর রেকর্ডই সে ব্যাংকে রয়েছে। বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের গ্রিন রোড শাখার ম্যানেজার সৈয়দ সালাহউদ্দিন বলেন, আমার শাখায় ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ক্ষতিগ্রস্ত অনেকেই একাউন্ট খুলে তাদের পেমেন্ট ক্যাশ করছেন। তারা যে হারে চেক জমা দিচ্ছেন, সে হারেই তাদের টাকা দেওয়া হচ্ছে। এখানে কোনটা ঘুষের টাকা সেটা নির্ণয় করার দায়িত্ব আমাদের নয়। তাছাড়া ডিসি অফিসের কারো সঙ্গে আমার কোন যোগসাজশ নেই। তাদের কাছ থেকে কোন সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ সঠিক নয়।

সর্বশেষ খবর