প্রবীণ রাজনীতিবিদ শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু এমপি প্রায়ই একটি কথা বলেন, পদ্মা সেতু আর পায়রা সমুদ্রবন্দর ঘিরে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চল হবে ‘সিঙ্গাপুর’। পায়রা হবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমুদ্রবন্দর। সিঙ্গাপুর সমুদ্রবন্দরকেও ছাড়িয়ে যাবে পায়রা। পায়রা বন্দর চালু হলে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দরের ওপর চাপ কমবে। সময় সাশ্রয়ের কারণে শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা আমদানি-রপ্তানির জন্য পায়রা বন্দরের দিকে ঝুঁকবেন। এ কারণে দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক শিল্প কারখানা, গার্মেন্ট, গোডাউন, শিপইয়ার্ড, শিপব্রেকিং ইয়ার্ড গড়ে উঠবে। এতে এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন গতি আসবে। তখন লাখ লাখ শ্রমিক দরকার হবে দক্ষিণাঞ্চলে। এই শ্রমিক জোগান দেওয়ার মতো প্রস্তুতি নেই। তাই এখন থেকেই শ্রমিক জোগান দেওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। আমদানি-রপ্তানিকারকদের দৃষ্টি এখন বরিশালে। ইতিমধ্যে বরিশাল থেকে কুয়াকাটা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত মহাসড়কের দুই পাশে জমি কেনার হিড়িক পড়েছে। বড় বড় শিল্পগ্রুপ বিশাল আয়তনের জমি কেনায় বেড়ে গেছে জমির দাম। ২০২৩ সাল নাগাদ পায়রা বন্দর পূর্ণাঙ্গভাবে চালুর আগেই ব্যাপক শিল্প কারখানা, গার্মেন্ট ও হাউজিং গড়ে উঠবে এখানে। পায়রা সমুদ্রবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমডোর মো. সাইদুর রহমান বলেন, একটি সমুদ্রবন্দর ঘিরে ওই এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য-শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে। পর্যটকরাও সেখানে আকৃষ্ট হন। সবকিছু মিলিয়ে পায়রা সমুদ্রবন্দর এ অঞ্চলের চেহারা পাল্টে দেবে বলে তার প্রত্যাশা। তিনি জানান, পায়রা সমুদ্রবন্দরের এখন পর্যন্ত পাঁচ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এ অবস্থায় গত বছরের শেষ দিকে বহির্নোঙরে মাদার ভেসেল থেকে পণ্য খালাসের উদ্বোধন হয়েছে। সংক্ষিপ্ত পরিসরে পায়রা বন্দরের সুবিধা ইতিমধ্যে পেতে শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা। বন্দরের জন্য জমি অধিগ্রহণ হয়েছে। বন্দরে যাওয়ার ফোর লেনের কাজ চলছে। প্রকল্পের অন্যান্য কাজও দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর পরিচালক ও বরিশাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মো. সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, শিল্পমন্ত্রী দেশের অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। তিনি
তার অভিজ্ঞতা থেকেই পায়রা বন্দর ও পদ্মা সেতু ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলে ‘সিঙ্গাপুরের’ হাতছানি দেখছেন। এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, পদ্মা সেতু হয়ে গেলেই বড়-ছোট অনেক শিল্পগ্রুপ বরিশালে তাদের কারখানা, গার্মেন্ট সম্প্রসারণ করবে। বরিশালে ব্যাপক শিল্প গড়ে ওঠার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন ধরনের শিল্পের কাঁচামাল পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে দ্রুত খালাস করা সম্ভব হবে। আবার ওই কাঁচামাল দিয়ে পণ্য উৎপাদনের পর তা দ্রুত পায়রা বন্দর দিয়ে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা সহজ হবে। ভারতের সেভেন সিস্টারস, ঢাকাসহ দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের আমদানি-রপ্তানিকারকরা সময় ও অর্থ সাশ্রয়ের জন্য চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দরে না গিয়ে পায়রা সমুদ্রবন্দরকেই বেছে নেবেন। এ ছাড়া ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানের চেয়ে বরিশালে শ্রমমূল্য কম থাকায় শিল্পোদ্যোক্তাদের পণ্য উৎপাদন খরচও কম পড়বে। এ কারণে পদ্মা সেতু আর পায়রা বন্দরের কাজ শেষ হলে বরিশালে শিল্প গড়ার প্রতিযোগিতা হবে বলে আশাবাদী জাহাজ ব্যবসায়ী রিন্টু। তবে অন্যান্য স্থানের শিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে বরিশালের শিল্পেও গ্যাস সংযোগ জরুরি উল্লেখ করে তিনি বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত সরকার দক্ষিণাঞ্চলে গ্যাসের সংযোগ দিতে না পারবে, ততক্ষণ এ অঞ্চলের শিল্পোদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের জন্য ঢাকাসহ অন্যান্য স্থানের চেয়ে তুলনামূলক কম সুদে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প সম্প্রসারণে এসএমই ঋণের শর্তগুলো আরও সহজ ও সাধ্যের মধ্যে আনার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান তিনি। কৃষিতেও সমৃদ্ধ বরিশাল। দেশের যে কোনো অঞ্চলের চেয়ে এখনো এখানে ধানের উৎপাদন বেশি। বরিশালে উৎপাদিত ধান উত্তরবঙ্গে যায়। খাদ্য চাহিদা মেটায় দেশের মানুষের। এখানে রয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় পেয়ারাবাগান। এ ছাড়া নানা কৃষিপণ্য উৎপাদিত হয় ধান-নদী-খালের দেশ বরিশালে।
এ ছাড়া কারিগরি শিক্ষার জন্য এখানে রয়েছে পৃথক পুরুষ ও মহিলা টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (টিটিসি), টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বিএসসি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। সদর উপজেলার সাহেবের হাট এলাকায় বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও কীর্তনখোলা নদীর কর্ণকাঠি প্রান্তে মেরিন একাডেমি নির্মাণের কাজ প্রায় সম্পন্ন। উচ্চশিক্ষার জন্য এখানে হয়েছে স্বপ্নের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। বরিশালে মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় অর্ধশতাব্দী আগে। পটুয়াখালীতেও মেডিকেল কলেজের কার্যক্রম শুরু হয়েছে দুই বছর হলো। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর এম মোয়াজ্জেম হোসেনের মতে, শিক্ষা বিস্তারের জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান আছে বরিশালে সেগুলোকে রাজনীতিমুক্ত রেখে যথাযথভাবে পরিচালনা করতে পারলে এর সুফল পাওয়া যাবে। তিনি বরিশালে একটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথা জানান। যোগাযোগব্যবস্থায়ও অনেক এগিয়েছে একসময়ের অনুন্নত দক্ষিণাঞ্চল। সরকারি-বেসরকারি দুটি বিমান সংস্থা যাত্রী পরিবহন করছে আকাশপথে। নৌপথে দক্ষিণাঞ্চলে পণ্য ও যাত্রী পরিবহন এখনো দেশের যে কোনো অঞ্চলের চেয়ে সুলভ ও সহজ। বরিশাল থেকে পায়রা বন্দর ও কুয়াকাটা মহাসড়কের লেবুখালীতে পায়রা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের কাজও এগিয়ে চলেছে দ্রুতগতিতে। ভাঙ্গা-বরিশাল-কুয়াকাটা-পায়রা বন্দর মহাসড়ক সম্প্রসারণের কাজ চলছে। ২০১৯ সালে উন্মুক্ত হচ্ছে পদ্মা সেতু। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে ফরিদপুর থেকে পায়রা বন্দর ও কুয়াকাটা সৈকত পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। কুয়াকাটায় পর্যটনশিল্পের উন্নয়নেও নানা পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। কলাপাড়ার আন্ধারমানিক নদের তীরে ১২০০ একর জমিতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও লেবুখালীর পায়রা নদীর তীরে বিশাল এলাকা নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট নির্মাণ চলছে। সবকিছু মিলিয়ে এখন ‘সম্ভাবনার আরেক নাম বরিশাল’।