শিরোনাম
রবিবার, ৫ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

ছোট ঋণে বড় হয়রানি

মামলায় ফেরারি ১ লাখ ৮০ হাজার কৃষক । দেড় বছরে ওয়ারেন্ট হয়েছে আরও ১২ হাজার চাষির নামে

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

ছোট ঋণে বড় হয়রানি

রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো থেকে বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে প্রতারক চক্র পার পেয়ে গেলেও ছোট ছোট ঋণ নিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন কৃষক ও বর্গা চাষিরা। সারা দেশে প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার কৃষকের নামে এখনো মামলা ঝুলছে। মামলায় অভিযুক্ত কৃষকের মধ্যে আবার ওয়ারেন্ট জারি হয়েছে ১২ হাজার ২৯২ জনের বিরুদ্ধে, এরা এখন অর্থ পরিশোধ করতে না পেরে গ্রেফতারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা এক হালনাগাদ প্রতিবেদনে কৃষিঋণ সার্টিফিকেট মামলার এ তথ্য দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্র মালিকানাধীন সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী এবং বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি) ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) এ মামলাগুলো দায়ের করেছে। এর মধ্যে অনেক মামলা রয়েছে যেগুলো দীর্ঘদিন ধরে চলে এলেও নিষ্পন্ন করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক। গত ৩৫ বছরের ধারাবাহিকতায় এসব মামলা চলছে। গত জানুয়ারিতেই শুধু নতুন করে মামলা হয়েছে ১ হাজার ৯৩০ জন কৃষকের বিরুদ্ধে। চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, কৃষকের নামে মামলার বিপরীতে ব্যাংকগুলোর প্রাপ্য টাকার পরিমাণ প্রায় ৫৬২ কোটি। অর্থাৎ প্রতি কৃষকের কাছে ব্যাংকের গড় পাওনা দাঁড়াচ্ছে মাত্র ৩১ হাজার ২২২ টাকা। আর এ টাকা আদায় করতে ব্যর্থ হয়েই মামলা ঠুকে দিয়েছে ব্যাংকগুলো।

সবচেয়ে বেশি মামলা করেছে কৃষি ব্যাংক (বিকেবি)। এ ব্যাংকটি একাই ৮৩ হাজার ৯৪৩ জন কৃষকের নামে মামলা করেছে, যাতে জড়িত অর্থের পরিমাণ প্রায় ২৯০ কোটি টাকা। বিশেষায়িত আরেক ব্যাংক রাকাব ১৪৬ কোটি টাকা খেলাপি হওয়ায় ২৮ হাজার ৯৯৩ জন কৃষকের নামে মামলা করেছে। বাকি মামলাগুলো করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব মামলায় দরিদ্র এমন অনেক বর্গা চাষি রয়েছেন, যাদের নিজের জমি নেই। দুর্যোগের কারণে বা উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে ব্যাংক থেকে নেওয়া কৃষিঋণের অর্থ পরিশোধ করতে পারেননি। এদের অনেকে আবার ৫ হাজার টাকার মূল ঋণ নিয়েছেন, যা ১০ থেকে ১৫ বছরে সুদে আসলে বেড়ে দ্বিগুণ বা তার বেশি হয়ে গেছে। ফলে অর্থ পরিশোধ করা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে ভূমিহীন বর্গা চাষির জন্য। উপরন্তু মামলা থাকায় নতুন করে তারা কোনো ব্যাংকঋণ নিতে পারছেন না। ফলে অর্থ পরিশোধের সুযোগও পাচ্ছেন না।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অল্প কিছু টাকার জন্য প্রান্তিক কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা করার এই বাধ্যবাধকতা থেকে ব্যাংকগুলোর সরে আসা উচিত। তাদের মতে, শত শত কোটি টাকার ঋণ নিয়ে অনেকে বছরের পর বছর আটকে রাখছেন। তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না ব্যাংক। অনেকে আবার হাজার কোটি টাকা জালিয়াতি করে নিয়ে যাচ্ছেন ব্যাংক থেকে। অথচ মাত্র ২০-৩০ হাজার টাকার জন্য কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে। কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে তাদের ঋণ পুনর্ভরণ করা উচিত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ছোট ছোট ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো অনেক সময় নিয়ম রক্ষার জন্য মামলা করে দেয়, যা বাড়তে বাড়তে লাখ ছাড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের উচিত হচ্ছে ঋণ প্রদানে অক্ষম দরিদ্র কৃষকের টাকা পুনর্ভরণ করে দেওয়া। এতে কৃষকও বেঁচে যাবে, ব্যাংকেরও নিয়ম রক্ষা হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, ছোট ছোট এই ঋণ আদায়ে শুরুতেই মামলা না করে আপস-মীমাংসার জন্য একাধিকবার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে। এর ফলে ব্যাংকের টাকাও উদ্ধার হয়, আবার খেলাপি কৃষকও হয়রানি থেকে বেঁচে যায়। এ ধরনের নির্দেশনায় কিছু ফল মিলেছে বলেও জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। কৃষিঋণ বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে কৃষকের বিরুদ্ধে এ ছয়টি ব্যাংকের অনিষ্পন্ন সার্টিফিকেট মামলার পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৯৩ হাজার ৩৮৩টি। আর সংশ্লিষ্ট অর্থের পরিমাণ ৫৮১ কোটি টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, গত ১০ মাসে মামলা কমেছে প্রায় ১৩ হাজার। যার মধ্যে গত জানুয়ারিতে নিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা ১ হাজার ৩৬৭টি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর