সোমবার, ৬ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

প্রতারণার বেড়াজালে শাহজালাল

যাত্রীদের মূল্যবান সামগ্রী ও পণ্য গায়েব বেড়েই চলেছে

জিন্নাতুন নূর

প্রতারণার বেড়াজালে শাহজালাল

যাত্রী সাধারণ সাবধান! রাজধানীর হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রতারক ও চোরচক্র। সাধারণ যাত্রীদের অনভিজ্ঞতা, ব্যস্ততা, কিছুটা ভয় ও সরলতার সুযোগে এই অসাধু চক্র তাদের মালামাল ও অর্থকড়ি লুটপাট করে নিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া এই বিমানবন্দরে অভিনব পদ্ধতিতে যাত্রীদের মূল্যবান সামগ্রী এবং রপ্তানির উদ্দেশ্যে পাঠানো পণ্য গায়েব করার ঘটনা দিনদিন বেড়েই চলছে। এই বিমানবন্দরে দায়িত্বরত সরকারের একাধিক সংস্থার সূত্রগুলো বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানায়, প্রতারণা ও চুরির ঘটনায় বিমানবন্দরের ভিতরের পরিচ্ছন্নতা কর্মী, বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের নিরাপত্তাকর্মী এবং ট্রাফিক সহকারীসহ কিছু পেশাদার প্রতারক ও চোর জড়িত। সাধারণত যারা গ্রাম থেকে প্রথমবারের মতো বিদেশে যান এবং বিমানবন্দর এলাকার নিয়ম-কানুন সম্পর্কে যারা ওয়াকিবহাল নন, তারাই বেশি প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। 

প্রতিবেদনে এ বিমানবন্দরের কয়েকজন ভুক্তভোগী যাত্রীর প্রতারিত হওয়ার কিছু ঘটনা তুলে ধরা হলো— সুমন মিয়া কাজ নিয়ে জেদ্দা যাবেন। ফ্লাইট দেরি থাকায় তিনি পরিবারের সঙ্গে পার্কিং এলাকায় অপেক্ষা করছিলেন। হঠাৎ দুই ব্যক্তি তার কাছে এসে নিজেদের সরকারি লোক বলে পরিচয় দেন। তারা সুমনকে বলেন যে, পদ্মা সেতু বানানোর জন্য টাকার প্রয়োজন। তাই যারা বিদেশ যাচ্ছেন তাদের কাছ থেকে ‘পদ্মা সেতু টোল’ নেওয়া হচ্ছে। সুমনকে দুই হাজার টাকা দিতে হবে। তা না হলে তিনি সৌদি আরব যেতে পারবেন না। সুমন মিয়া তীরে এসে তরী ডুবাতে চান না। দুই আগন্তুকের সঙ্গে দফারফা করে অবশেষে ৫০০ টাকা দিয়ে নিজের সৌদি যাত্রার সুযোগ নিশ্চিত করেন। কুয়েত ফেরত কালাম ইমিগ্রেশন পেরিয়ে এসে নিজের লাগেজের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় এক ট্রাফিক হেলপার  কালামের ট্যাগ নম্বর দেখতে চাইলেন। কালাম তা বের করে দিলেন। কিন্তু সেই হেলপার বললেন, এতে হবে না। তিনি তার লাগেজ বা ব্যাগ বেল্ট থেকে নিতে পারবেন না। অবশেষে নিরুপায় কালাম সেই কথিত হেলপারের হাতে কুয়েতি তিন দিনার গুঁজে দিয়ে বেল্ট থেকে নিজের ব্যাগ নামানোর সুযোগ পান। নিউইয়র্ক প্রবাসী মোস্তফা। দেশে ছুটি কাটিয়ে আবার নিউইয়র্ক ফেরত যাচ্ছিলেন। ক্যানোপিতে প্রবেশের পর নিজের লাগেজটি র‌্যাপিং করে নেওয়ার কথা ভাবলেন। র‌্যাপিংয়ের জায়গায় গিয়ে দেখেন পাশেই ওয়েট মেশিন। মোস্তফা তার লাগেজ ওজন করে দেখলেন যে তা নির্ধারিত সীমা থেকে পাঁচ কেজি বেশি। এ সময় পাশে দাঁড়ানো এত ব্যক্তি নিজ উদ্যোগে মোস্তফাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। তিনি মোস্তফাকে আস্বস্ত করে বলেন, কোনো সমস্যা নেই, সব ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। এজন্য ২০ ডলার দিতে হবে। মোস্তফা এ প্রস্তাবে রাজিও হলেন। ওই ব্যক্তি চেক-ইন কাউন্টার ঘুরে এসে মোস্তফাকে বলেন, আমি বলে এসেছি, কোনো অসুবিধা হবে না। এরপর মোস্তফা তাকে ২০ ডলার দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে কাউন্টারে রওনা হন। কিন্তু কাউন্টারে গিয়ে বাধল বিপত্তি। এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ বাড়তি ওজনের জন্য মোস্তফার কাছে বাড়তি টাকা দাবি করল। তিনি পেছন ফিরে আর সেই ব্যক্তির দেখা পেলেন না। ইতালি প্রবাসী করিম ছুটিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন। ইতালি ফিরে যাওয়ার সময় করিমের দুলাভাই রাতে বিমানবন্দরে নামিয়ে দেন। বাংলাদেশি সিমটা যেহেতু প্লেনে উঠার পর আর চালু রাখা যাবে না, এ কারণে করিম সিমটি তার দুলাভাইকে দিয়ে দেন। পরদিন সকালে করিমের মার কাছে একটি ফোন যায়, অপরিচিত কণ্ঠের একজন বলেন যে, ‘আপনার ছেলে টিকিট-পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলেছেন। ইতালি যেতে পারছেন না। দ্রুত একটি নম্বরে ৫০ হাজার টাকা বিকাশ করেন। আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।’ এ সময় ছেলের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন করিমের মা। ছেলের কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে, অন্যপাশ থেকে আরেকজনের ছোট্ট উত্তর আসে ‘হু..’। করিমের মা বিচলিত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে টাকা বিকাশ করে পাঠান। করিমের আরেক আত্মীয় যখন বিষয়টি জানতে পারেন তখন তিনি আর্মড পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।  জানতে পারেন যে, করিম কোনো ঝামেলা ছাড়াই নির্দিষ্ট সময়ে ইতালির উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া ফ্লাইটে উঠেছেন। এভাবেই বিমানবন্দরে সুমন, কালাম ও মোস্তফার মতো প্রতারণার শিকার হচ্ছেন আরও অনেক প্রবাসী ও বিদেশগামী যাত্রী এবং তাদের স্বজনরা।

 এসব ঘটনার কিছু কিছু জানা গেলেও অনেকগুলোই অজানা থেকে যাচ্ছে। এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন সূত্রে জানা যায়, বিমানবন্দরে প্রায়ই যাত্রীদের এই ধরনের প্রতারণা শিকার হতে হয়। অনেক সময় ভুক্তভোগী সচেতন না হওয়ায় এমন প্রতারণার শিকার হন। প্রতারকদের সঙ্গে বিমানবন্দরে সক্রিয় আছে চোরচক্রও। তাদেরই একজন সেলিম সরকার। বিমানে হোল্ড এরিয়াতে যাত্রীদের মালামাল-ব্যাগ সাজিয়ে রাখার বাহানায় তিনি দীর্ঘদিন তাদের মূল্যবান সামগ্রী চুরি করেছেন। ভয়েজার এয়ারলাইন্সে চাকরি করতেন সেলিম। সাধারণত এই স্থানে অন্য কারও থাকা বা নজরদারি করা সম্ভব নয়। কিন্তু সেলিম সেখানে নিশ্চিন্তে ঢুকে ব্যাগ খুলে বের করে নিতেন যাত্রীদের বৈদেশিক মুদ্রা। তবে এই মুদ্রা বা টাকা তিনি পকেটে না রেখে  কৌশলে মাথার টুপিতে রাখতেন। অবশেষে আর্মড পুলিশের হাতে ধরা খান সেলিম। বিমানবন্দরের এক্সপোর্ট কার্গোর সামনের ম্যানহোল থেকেও সম্প্রতি রপ্তানির উদ্দেশ্যে রাখা ১৭০ পিস জিন্সের প্যান্ট উদ্ধার করা হয়। কার্গোর ভিতর থেকে চুরি করে ম্যানহোলের ভিতরে এই মালামাল লুকিয়ে রাখা হয়। এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশের এএসপি তারিক আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিমানের পরিচ্ছন্নতাকর্মী, বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানির এয়ারলাইন্সের কর্মচারী, বিমানবন্দর এলাকায় ভাড়া গাড়ির ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা এই অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। প্রতারণার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের আমরা ম্যাজিস্ট্রেট  কোর্টের কাছে হস্তান্তর করি। আমরা এয়ারপোর্টের ক্যানোপি এলাকা ও ডিপার্টচার এলাকায় যাত্রী ছাড়া অন্য কাউকে আসতে দেই না। কারণ এসব এলাকায় ভিড় বেশি হলে প্রতারক ও চোরচক্র ভিড়ের মধ্যে মিশে সহজেই অপরাধ কর্মকাণ্ড ঘটান।

সর্বশেষ খবর