শিরোনাম
শনিবার, ১১ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

সাতক্ষীরার সেই পরিবারে চলছে শিকল বেঁধে ঝাড়ফুঁক

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি

সাতক্ষীরার সেই পরিবারে চলছে শিকল বেঁধে ঝাড়ফুঁক

মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়া একটি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সাতক্ষীরা তালা উপজেলার প্রসাদপুর গ্রামে শুরু হয়েছে ঝাড়ফুঁকের মহোৎসব। শুরুতেই চিকিৎসকদের কাছে না নিয়ে এসব তৎপরতা চালানোয় গোটা পরিবারের সবাই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

এই পরিবারটির প্রধান হলেন ৬৫ বছর বয়সী রহমত বিশ্বাস। তার পরিবারে রয়েছে পাঁচ ছেলে, তিন মেয়ে ও এক পুত্রবধূসহ ১৩ জন সদস্য। রহমত এক সময় দিনমজুরের কাজ করলেও বছর তিনেক আগে পুকুর ইজারা নিয়ে মাছ চাষ শুরুর পর তার অবস্থা ফিরতে শুরু করে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ফরিদ হোসেন জানান, কোনো কারণে মানসিক আঘাত থেকে রহমত পরিবারের সদস্যরা অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকেন। কিন্তু কুসংস্কারে বিশ্বাসী লোকজনের চাপে রহমত ও তার স্ত্রী তাদের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিদের হাসপাতালে পাঠাতে রাজি হচ্ছেন না। এই সুযোগে ঝাড়ফুঁকের মহোৎসব জমিয়ে তোলা হয়েছে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়া এই পরিবার সদস্যদের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে পারেনি স্থানীয় প্রশাসন। উল্টো ঝাড়ফুঁককারীরা নানা গুজব ছড়িয়ে এলাকায় এক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। সরেজমিন দেখা গেছে, ওই পরিবার সদস্যদের ‘সুস্থ করতে’ এলাকাবাসী বিপুল উৎসাহে ফকির-কবিরাজ দিয়ে শেকলে বেঁধে ঝাড়ফুঁঁক দিয়ে চলেছেন। তারা পরিবারের ‘অস্বাভাবিক’ সদস্যদের জোর করে খাওয়াচ্ছেন, পিকআপ ভাড়া করে শেকলে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছেন কথিত পীর আর ওঁঝার কাছে। রাত-দিন উত্সুক মানুষের ভিড় জমে থাকছে বাড়ির চারপাশে। জানা গেছে, চলতি মাসের শুরুতে রহমত পরিবারের কয়েকজন অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করেন। তারপর এর প্রভাব পড়ে পরিবারের অন্যদের ওপর। খবর পেয়ে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা গত সপ্তাহে ওই বাড়িতে গিয়েছিলেন। সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকেও চিকিৎসক পাঠানো হয়। কিন্তু স্থানীয়দের চাপে তারা কাউকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে রাজি করাতে পারেননি। রহমতের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, এলাকার লোকজন ওই পরিবারের সদস্যদের ‘পাগল’ সাব্যস্ত করে ‘জিন ছাড়ানোর’ চেষ্টায় ব্যস্ত রয়েছেন। রহমতের দুই ছেলে ও এক মেয়েকে তার পাঁচ বছরের মেয়েসহ ঘরের মধ্যে আটকে রাখা হয়েছে। আরেক ছেলেকে পায়ে শেকল পরিয়ে আটকে রাখা হয়েছে জানালার সঙ্গে। রহমতের স্ত্রী নবীজান বিবির ভাষ্য, তাদের এক মেয়েকে শ্বশুরবাড়ির লোকজন ‘পাগল সাব্যস্ত করলে’ চলতি মাসের শুরুতে তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়। এরপর থেকেই ছেলে, মেয়ে, নাতি, নাতনিদের মধ্যে ‘অস্বাভাবিকতা’ দেখা দেয়। তিনি বলেন, ‘যারা এখনো ভালো আছে, তারা যাতে পাগল না হয় সেজন্য তাবিজ করা হয়েছে।’ রহমত বিশ্বাসও বলেন, ‘আমার এক মেয়েকে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন জাদু করে জিনের মাধ্যমে পাগল করে দিয়েছে। সে কারণে বাড়ির অন্যরাও একে একে পাগল হয়ে যাচ্ছে।’ তার বড় ছেলে হায়দার বিশ্বাস, প্রতিবেশী সুফিয়ান শেখ, রহিমা বেগম, খায়রুল বিশ্বাসও একই সুরে কথা বলেন। রহমতের বড় ছেলে হায়দার উল্লেখ করেন, ‘এলাকাবাসীর সহযোগিতায়’ বোনের শ্বশুরবাড়ির লোকদের করা ‘জাদু নষ্ট করার জন্য’ পাল্টা তাবিজ করা হয়েছে। প্রতিবেশীর অনেকেই বলেন, ‘বাড়ির পাশে এতগুলো লোক পাগল হয়ে গেল... বিবেকের তাড়নায় আমরা কাজ-কাম ছেড়ে দিয়ে সারাদিন পাগল সেবা করছি। গ্রামের লোক এসে পাগলদের জোর করে ভাত, কলা ও সাগু খাওয়াচ্ছে।’ তারা জানান, হাসপাতালে নেওয়া না হলেও রহমতের পরিবারের সদস্যদের ঝাড়ফুঁক দিতে নেওয়া হচ্ছে দূর-দূরান্তে। গ্রামের মাসুদ বিশ্বাস জানান, রহমতের ‘জিনে ধরা ছেলেমেয়ের’ চিকিৎসার জন্য বেঁধে গত সোমবার সন্ধ্যায় একটি পিক-আপে তুলে যশোরের নওয়াপাড়ার ‘পীর সাহেবের’ কাছে নিয়ে যান তারা। সেখানে কোনো উপকার না পাওয়ায় মঙ্গলবার তাদের মিকশিমিল আমুরডাগা এবং ডুমুরিয়ার দুই ওঁঝার কাছে নেওয়া হয়। সেখানেও কোনো লাভ হয়নি। তাই বুধবার কেশবপুর থেকে আরও দুজন ওঁঝাকে বাড়িতে আনা হয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা কুদরত-ই-খোদা বলেন, ‘কোনো কারণে গুরুতর মানসিক আঘাত পেয়ে তারা ভারসাম্য হারিয়েছেন। প্রয়োজনীয় খাবার, ঘুম আর চিকিৎসা পেলে সবাই সুস্থ হয়ে উঠবেন। কিন্তু জোর করে তো কাউকে চিকিৎসা দেওয়া যায় না।’ জেলা প্রশাসক আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘ইউএনওকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। রহমত বিশ্বাসের মতামত নিয়ে তাদের যেকোনো ধরনের সহযোগিতার প্রয়োজন হলে তা ইউএনওকে করতে বলা হয়েছে। রহমতের মতামত নিয়ে সাতক্ষীরা সদরে নিয়ে অথবা যেকোনো জায়গায় তাদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেও বলা হয়েছে।’

সর্বশেষ খবর