মঙ্গলবার, ২১ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

নৈরাজ্যের শেষ নেই গণপরিবহনে

ভাড়া আদায়ে স্বেচ্ছাচারিতা, সিটিং, গেটলট, স্পেশাল সার্ভিসের নামে প্রতারণা

শিমুল মাহমুদ

নৈরাজ্যের শেষ নেই গণপরিবহনে

রাজধানীর গণপরিবহনে নজিরবিহীন নৈরাজ্য চলছে। নগরীর পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা বলতে কিছুই আর নেই। ভাড়া আদায়ে স্বেচ্ছাচারিতা, সিটিং, গেটলট, স্পেশাল সার্ভিসের নামে প্রতারণা, যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, ফিটনেসবিহীন গাড়ির ঝুঁকিপূর্ণ চলাচল, ট্রাফিক অব্যবস্থাপনাসহ নানা কারণে গণপরিবহন এখন যাত্রী দুর্ভোগের বাহন হয়ে উঠেছে। পরিবহন মালিক শ্রমিকদের স্বার্থের সিন্ডিকেটের কারণে পদে পদে লাঞ্ছনা ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা।    

সিটি সার্ভিসে ট্রাফিক নৈরাজ্য, চালকদের আইন না মানার প্রবণতা, অতিরিক্ত যাত্রী তুলতে বাসের রেসসহ বিভিন্ন কারণেই রাজধানীর গণপরিবহন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। উপরন্তু যানবাহনের তুলনায় নগরীতে রাস্তার পরিমাণও কম, মাত্র ৮৮ কিলোমিটার। এর মধ্যেই চলছে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ যানবাহন। বিদ্যমান রাস্তারও এক-তৃতীয়াংশ বেদখল হয়ে আছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী যান চলাচলের জন্য কোনো শহরের মোট আয়তনের ২৫ ভাগ রাস্তা থাকা উচিত। রাজধানীতে সড়ক রয়েছে আয়তনের প্রায় ৮ শতাংশ। ফলে, যানজট নগরবাসীর নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে। তারপরও প্রতিদিন নগরীতে ব্যক্তিগত গাড়ি নামছে বিপুল সংখ্যায়। গত বছর ঢাকার রাস্তায় প্রাইভেট কার নেমেছে ১৮ হাজার ১০টি। দিনে ৫০টি করে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দু’মাসে প্রাইভেট কার নেমেছে ৩৪১৭টি। দিনে ৫৭টি করে। অন্যদিকে দিনে দেড়শর বেশি মোটরবাইক নামছে রাজপথে। গত বছর মোটরসাইকেল নেমেছে ৫৩ হাজার ৭৩৮টি, দিনে ১৪৯টি করে। গত দুই মাসে নেমেছে ১০ হাজার ৭৯টি, দিনে ১৬৭টি করে। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কার্যকর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে রাজধানীর গণপরিবহনে নৈরাজ্য বন্ধ করা যাবে না।  এদিকে নগর পরিবহনে সিটিং, ডাইরেক্ট, গেটলক ও স্পেশাল সার্ভিসের নামে নজিরবিহীন নৈরাজ্য চলছে। মোটরযান আইন, সরকার নির্ধারিত ভাড়া সবকিছু উপেক্ষা করে যথেচ্ছ হয়রানিতে লিপ্ত পরিবহন মালিক শ্রমিকরা। ফলে যাত্রীদের গুনতে হচ্ছে মালিকদের নির্ধারিত অতিরিক্ত ভাড়া। সেটাও কিলোমিটার হিসাবে নয়, পরিবহন মালিকদের ইচ্ছা মতো চাপিয়ে দেওয়া। অল্প দূরত্বের যাত্রীকে গুনতে হচ্ছে পুরো পথের ভাড়া। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অল্প দূরত্বের যাত্রীদের বাসেও তোলা হচ্ছে না। বিশেষ করে সিটি সড়কের মধ্যবর্তী এলাকার যাত্রীদের ভোগান্তিকে সঙ্গী করে নিজেদের গন্তব্যে যাতায়াত করতে হয়। রাজধানীর শেওড়াপাড়া থেকে মতিঝিলে অফিস করেন বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর্মী আবদুল হাকিম। তিনি বলেন, প্রতিদিন সকালে অফিসে যেতে রীতিমতো যুদ্ধে নামতে হয়। সকালে মিরপুর-পল্লবী থেকে যেসব বাস ছেড়ে আসে  সেগুলোর প্রায় সবই ‘সিটিং’, ‘গেটলক’ হিসেবে দরজা বন্ধ করে মাঝপথের হাজার হাজার যাত্রীর সামনে দিয়ে গন্তব্যের দিকে চলে যায়। আমরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকি। তালতলা,  শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়ার যাত্রীরা এ সময় বাসে উঠতে পারেন না। এ জন্য তাদের সকাল ৯টায় অফিস ধরতে ৭টার আগেই রাস্তায় নামতে হয়। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সকালে অফিস যাত্রার সময়ে বাসে ওঠা এক কঠিন যুদ্ধের মতো।

ভাড়া ডাইরেক্ট, সার্ভিস লোকাল : রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাসগুলোর মালিক সমিতি সিটিং, ডাইরেক্ট, লোকাল সিটিং, গেটলক, স্পেশাল ইত্যাদি বাহারি নামে যাত্রী পীড়নের সব আয়োজন দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে আসছে। অনেক বাসে একটাই ভাড়া, যাত্রী যেখানেই নামুক না কেন। ভাড়া ডাইরেক্ট হলেও যাত্রী কম পেলে তারা যে কোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে লোকাল বাসের মতোই যাত্রী তুলতে দ্বিধা করে না। টঙ্গী-সদরঘাট রুটে চলাচলকারী সুপ্রভাত পরিবহন এক সময় ছিল এই রুটের সবচেয়ে খারাপ বাস সার্ভিস। এটি এখন সুপ্রভাত স্পেশাল সার্ভিস নাম দিয়ে প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করছে। তাদের ১৫ টাকার নিচে কোনো ভাড়া নেই। যাত্রী তোলে হাত দেখালেই। পরিবহন কর্মীরা ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে প্রায়ই দুর্ব্যবহার করে। জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভার দিয়ে টঙ্গী থেকে মিরপুরে চলাচলকারী বাসগুলোও গলা কাটা ভাড়া আদায় করে। শুধু ফ্লাইওভার পার হতেই ২০টাকা আদায় করে এই রুটে চলাচলকারী সব পরিবহন।      

লোকাল বাসের খোঁজ নেই : নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের তদারকির অভাবে বর্তমানে মিরপুর-মতিঝিল বা মিরপুর-গুলিস্তান রোডে কোনো লোকাল বাস নেই। সব সার্ভিসই ডাইরেক্ট, সিটিং। কিন্তু অফ পিকআওয়ারে এসব বাস চলে লোকালের মতো, ভাড়া দিতে হয় ডাইরেক্ট বাসের। একই অবস্থা মিরপুর থেকে নগরীর অন্য রুটগুলোতে চলাচলকারী বাস সার্ভিসের ক্ষেত্রেও। মিরপুর থেকে চলাচলকারী চয়েজ, সিল্কসিটি, বিকল্প, বিহঙ্গ, শিখর, ইটিসি, ইউনাইটেড, দিশারী, নিউভিশন, সুপার সিটিং, শিকড়সহ বিভিন্ন কোম্পানির মিনিবাস সিটিং সার্ভিস হিসেবে চলছে। এ ছাড়া গাজীপুর পরিবহন, প্রভাতী, আজমেরীসহ আরও কয়েকটি পরিবহন একই কায়দায় সিটিংয়ের নামে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যখন বিভিন্ন কারণে রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কমে যায় তখন যাত্রীদের দুর্ভোগকে পুঁজি করে লোকাল মিনিবাসগুলোও ‘সিটিং সার্ভিস’ ঘোষণা করে। এমনকি দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়া আদায় করতেও দ্বিধা করে না।

অভিযোগ শোনার কেউ নেই : অনিয়ম দূর করার দায়িত্ব যাদের, তাদের নাকের ডগায় এভাবে অনিয়ম ঘটছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএতে যাত্রীদের অভিযোগ আমলে নিয়ে প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থাই নেই। তারা মাঝে মাঝে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার উদ্যোগ নিলেও পুলিশি সহযোগিতার অভাবে সেটা কার্যকর হয় না। পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা নিজেদের স্বার্থের ব্যাপারে বেপরোয়া। পুলিশও প্রায় সব ক্ষেত্রেই নির্বিকার থাকে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, নগর পরিবহনের নৈরাজ্য রোধে যাত্রীদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। ঢাকা মেট্রোপলিটন রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটিতে (মেট্রো আরটিসি) যাত্রীদের কোনো প্রতিনিধি  নেই। পরিবহন মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে নগর পরিবহনে নৈরাজ্য বন্ধ হচ্ছে না।

 

সর্বশেষ খবর